বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ বন্ধে ২১৫ বছর লাগবে

ডয়েচে ভেলে

শুক্রবার, ০৭ জুন ২০২৪ , ০৩:৩২ পিএম


বাল্যবিবাহ
ছবি: সংগৃহীত

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাল্যবিবাহে বাংলাদেশ এখনও শীর্ষে। বাংলাদেশে এখন প্রতিবছর দুই শতাংশ হারে বাল্যবিবাহ কমছে। তবে এই গতিতে বাংলাদেশ থেকে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে ২১৫ বছর লেগে যাবে।

বিজ্ঞাপন

ঢাকায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ নিয়ে এক অনুষ্ঠানে বুধবার এই অভিমত দিয়েছেন বাংলাদেশে ইউএনএফপিএর প্রতিনিধি ক্রিস্টিন ব্লখুস। তার মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে বাংলাদেশকে বাল্যবিবাহ নির্মূলের চেষ্টা এখনকার চেয়ে ২২ গুণ বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে এখন বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশ।

এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কেয়া খান ডিডাব্লিউকে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি। তবে আমাদের আরো সর্বাত্মকভাবে কাজ করতে হবে। আমাদের মাত্র ১০ জেলায় অ্যাকশন টু এনড চাইল্ড ম্যারেজ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। সরকারের একার পক্ষে সব কিছু সম্ভব নয়। সবার সহযোগিতা দরকার।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ের হার ২০০৬ সালে ৬৪ শতাংশ, ২০১২ সালে ৫২ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে ৫১ শতাংশ ছিল। তাদের হিসাবে দেশে এখন চার কোটি ১৫ লাখ মেয়ে ও নারী বিবাহিত এবং সন্তানের মা। গত ১০ বছরে বাল্যবিবাহ কমার যে হার দেখা যাচ্ছে, সে হার দ্বিগুণ হলেও ২০৩০ সালে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার হবে প্রায় ৩০ শতাংশ।

২০৫০ সালের মধ্যে এ হার ১৫ শতাংশের নিচে নামবে। দেশে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার প্রায় ৪২ শতাংশ। ১৫ বছরের কম বয়সীদের বাল্যবিবাহের হার ৮ শতাংশ। বাল্যবিবাহের দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে।

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০২২ অনুসারে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশ। এ হার আফগানিস্তানে ৩৫, ভারতে ২৭, পাকিস্তানে ২১, নেপালে ১০ ও শ্রীলঙ্কায় চার শতাংশ।

বিজ্ঞাপন

ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ প্রকল্পের প্রধান জ্যেষ্ঠ পরিচালক চন্দন জেড গোমেজ বলেন, আসলে করোনার সময় বাল্যবিবাহ বেড়ে গেছে। সেটা নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারের দিক থেকে নতুন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এর জন্য যে সমন্বিতভাবে কাজ করা দরকার তারও অভাব আছে।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, শুধু মেয়েরা নয়, ছেলেরাও বাল্য বিবাহের শিকার হচ্ছে। আমরা বাল্যবিবাহ ঠেকানোর নানা খবর সংবাদমাধ্যমে দেখি। নানা নেটওয়ার্ক কাজ করছে। কিন্তু বাস্তবে এই প্রচারের চেয়ে কাজ হচ্ছে কম।

তিনি মনে করেন, করোনার সময় স্কুল থেকে অনেক মেয়ে ঝরে পড়েছে। তাদের আর স্কুলে ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তাদের অধিকাংশই বাল্যবিবাহের শিকার। আর সেটা সঞ্চারিত হয়ে বাল্যবিবাহের প্রবণতা আবার বাড়ছে। সামাজিক কুসংস্কার ও ধর্মীয় প্রভাব আগের চেয়ে কমে আসলেও বাল্যবিবাহের অর্থনৈতিক কারণ এখনো দূর হয়নি। মেয়েদের বিয়ে দেয়াকে এখনো অনেকে তাদের প্রতিষ্ঠিত হওয়া বলে মনে করেন।

বুধবার মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ইউএনএফপিএ ও ইউনিসেফের সহযোগিতায় বাল্যবিবাহ বন্ধে যৌথ বৈশ্বিক কর্মসূচির তৃতীয় পর্যায়ের উদ্বোধন হয় ঢাকায়। সেখানে ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরী সানজিদা ইসলাম জানান, গত বছর প্রতিবেশীদের কথায় প্রভাবিত হয়ে মা-বাবা আমার বাল্যবিবাহ দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল। পরে শিশু সুরক্ষা হাবের কাউন্সিলরদের সহায়তায় তার মা-বাবা বাল্যবিবাহ দেওয়া থেকে সরে আসেন।

সানজিদা বলেন, আমার অনেক স্বপ্ন আছে। আমি খেলতে ভালোবাসি। এখন আমি নিজের স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে যেতে পারবো। দেশে বাল্যবিবাহের শীর্ষে যে দশটি জেলা তার মধ্যে সাতক্ষীরা একটি। সাতক্ষীরা পৌরসভার পলাশপোল এলাকায় তিন দিন আগে নবম শ্রেণির ছাত্রী শিরিনা আক্তারকে বিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলো তার পরিবারের সদস্যরা। সে তার স্কুলের সহপাঠীদের মাধ্যমে একটি স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপকে খবর দেয়। তারা গিয়ে বিয়ে বন্ধ করতে সক্ষম হন।

শিরিনা জানান, আসলে আমি আরো পড়ালেখা করতে চাই। কিন্তু আমার আত্মীয় স্বজনের বুদ্ধিতে বাবা বিয়ের আয়োজন করেছিলেন। আমার সহপাঠীরা সাহস দেয়। তারাই স্বেচ্ছাসেবকদের খবর দেয়।

তার বাবা হাসান গাজী বলেন, আমি ঝালাইয়ের কাজ করি। ভালোর পাত্র পেয়ে বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। সমাজে তো থাকতে হবে। তবে এখন আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। তার পড়াশুনা শেষ হওয়ার আগে বিয়ে দেয়ার ইচ্ছে আমার আর নাই। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করেছেন সাতক্ষীরার তরুণ মো. সাকিবুর রহমান।

তিনি বলেন, আসলে বিয়ে হয়ে গেলে ধর্মীয়ভাবে সেটা তো আর অবৈধ হয় না। আইনে মেয়েদের ১৮ এবং ছেলেদের ২১ বছর সর্বনিম্ন বিয়ের বয়স। কিন্তু এর চেয়ে কম বয়সে হলে বিয়ে তো আর বাতিল হবে না। আইনে কাজির শাস্তি আছে। অভিভাবক এবং প্রাপ্তবয়স্ক বরের শাস্তি আছে। কিন্তু বিয়ে তো অবৈধ করা যাবে না। এই সুযোগ এখন অনেকেই নেন। এটা প্রতিরোধে উপজেলা পর্যায়ে তথ্য পাওয়া গেলেও সামাজিক কারণে সব সময় প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় না। এর জন্য শক্ত অবস্থানে যেতে হলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ লাগে। সব সময় তাদের পাওয়া যায় না।

দেশের আরো কয়েকটি এলাকায় কথা বলে জানা গেছে, অভিভাবকেরা আর্থিক বিষয় ছাড়াও নিরাপত্তার অজুহাতেও বাল্যবিবাহের আয়োজন করেন। আর আত্মীয় স্বজনরা প্রভাবক হিসাবে কাজ করেন। তারা মেয়েদের নানা সম্পর্কের কথা বলে দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন।

নীলফামারী জেলায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করা একটি এনজিওর সিনিয়র ম্যানেজার লোটাস টিসিম বলেন, আমরা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, মেম্বারদের সহায়তায় বাল্যবিবাহ বন্ধ করার পরও সেই বিয়ে পরে আবার হয়েছে এমন অনেক ঘটনা আছে। অভিভাবকেরা মনে করেন ভালো পাত্র পরে আর পাওয়া যাবে না। তাই অন্য গ্রামে নিয়ে বা গভীর রাতে বিয়ে দেন। বাল্যবিবাহ রোধের আইন আরো কঠোর হওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।

মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কেয়া খান বলেন, আমরা আরো অনেক সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিয়েছি। এরমধ্যে একটি হলো স্কুলগুলোতে বাল্যবিবাহ নিরোধক কর্মসূচি। সেখানে বলা হচ্ছে, শিক্ষা আগে, পরে বিয়ে। ১৮ এবং ২১ পেরিয়ে। আমরা দুর্গম এলাকায় ছাত্রীদের সাইকেলও দেবো, যাতে তারা স্কুলে যেতে পারে। এছাড়া আমাদের সারাদেশে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত কমিটি আছে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে। তবে সবাই মিলে কাজ করতে হবে। তা না হলে সুফল পাওয়া যাবে। নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য সরকারের নানা কর্মসূচি আছে। ফলে বাল্যবিবাহের জন্য অর্থনৈতিক কারণকে বড় করে দেখার কিছু নেই বলে মনে করেন কেয়া খান। এ ব্যাপারে অভিভাবকদেরও সবচেয়ে বেশি সচেতন করে তোলার ওপর জোর দেয়ার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন
Advertisement
Advertisement

Loading...


© All Rights Reserved 2016-2025 | RTV Online | It is illegal to use contents, pictures, and videos of this website without authority's permission