• ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
logo

করোনায় অর্থনীতি: হাল ধরবে কৃষি

সৈয়দ আশিক রহমান

  ০৪ এপ্রিল ২০২০, ১৮:৩৮
সৈয়দ আশিক রহমান

বৈশ্বিক মহামারিতে রূপ নেয়া নভেল করোনাভাইরাস এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক। জাতিসংঘ বলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এরচেয়ে বড় সংকটে বিশ্বকে আর পড়তে হয়নি। চলতি প্রজন্মকেও হয়তো নিকট ভবিষ্যতে এরচেয়ে বড় সংকটে পড়তে হবে না। ইতোমধ্যে করোনার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিশ্ব ও দেশীয় অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সমাজে। ঠিক কতোটা ক্ষতির মুখে পড়বে অর্থনীতি, তা হয়তো এখনই বলা সম্ভব নয়, তবে যে আলামত দেখা যাচ্ছে তাতে অংকটা এবং চেইন ইফেক্ট যে অনেক বড় হবে তা গবেষণা ছাড়াই অনুমান করা যায়। করোনার প্রভাবে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেরই অর্থনৈতিক কর্মকান্ড প্রায় থমকে গেছে; স্থবিরতা নেমেছে উৎপাদন, পরিবহন ও বিপণন ব্যবস্থায়। বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক চীন, আমেরিকা ও ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে এই ভাইরাস ধস নামিয়েছে।

অর্থনীতিতে এর ভয়াবহতা কতটুকু তা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সম্প্রতি এক ভাষণের কিছু কথাতেই আন্দাজ করা যায়। তিনি আমেরিকানদের সতর্ক করে বলেছেন, করোনার প্রভাবে অনেক আমেরিকান নিঃস্ব হয়ে পড়বে অথচ সেসব লোকের কিছু দিন আগেও সব ছিল। পরিস্থিতি এতোটাই ভয়াবহ হতে পারে যে, বিপুল সংখ্যক মানুষ হতাশায় আত্মহনণের পথ বেঁছে নেবে। তার চেয়েও ভয়াবহ হচ্ছে অনেকেই হতাশায় মাত্রাতিরিক্ত মাদকাসক্ত হয়ে রাস্তায় মরে পড়ে থাকবে।

বিশ্বের প্রভাবশালী অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনার প্রভাবে বিশ্বে কয়েক কোটি মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়বে। অনেক ধনী মানুষ পুঁজি হারাবেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার হিসাবে বিশ্বজুড়ে অন্তত আড়াই কোটি মানুষ চাকরি হারাবেন। মার্কিন শ্রম বিভাগ জানিয়েছে, গত ২৮ মার্চ পর্যন্ত আমেরিকায় ৬৬ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে।

অনেকেই হয়তো বলবেন, এখনই অর্থনৈতিক অভিঘাত মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে ভাবার সময় আসেনি। কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে, যদি এখনই পরিকল্পনা করে পদক্ষেপ নেয়া না হয় তাহলে ভবিষ্যতে যে বিপর্যয় দেখা দেবে, তা তাৎক্ষণিকভাবে মোকাবিলা করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। মনে রাখতে হবে, করোনায় প্রতিটি দেশই বিপর্যস্ত। এমন পরিস্থিতিতে অন্যদেশ থেকে সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়বে। এমনও হতে পারে যে টাকা দিয়েও অন্য দেশ থেকে পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। ভিন্নতরো এই বাস্তবতায় অভ্যন্তরীণ উৎসগুলোকে প্রণোদিত করে উৎপাদন (কৃষি এবং শিল্প) ব্যবস্থা সচল রাখার পাশাপাশি গ তিশীল করতে পারা না পারার মধ্যেই আসলে ভবিষ্যত নিরাপত্তা নিহিত। করোনার কারণে যে মারাত্মক ধস দুয়ারে কড়া নাড়ছে, তা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হলে খাত ভিত্তিক সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে।

দ্য ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের রিপোর্ট বলছে, করোনার প্রভাবে চলতি বছর যেখানে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা ছিল ৮ শতাংশের কাছাকাছি, সেখানে তা হবে সাড়ে ৩ শতাংশের মতো। ভারতেও প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ থেকে কমে হবে ২ শতাংশ। আর পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার প্রবৃদ্ধি থমকে যাবে।

আমাদের অর্থনীতির প্রধান তিন খাত, কৃষি, পোশাকশিল্প ও রেমিট্যান্স। শেষ দুটির সঙ্গে সরাসরি বৈশ্বিক অর্থনৈতিকক বাস্তবতা জড়িত। করোনায় যেহেতু বৈশ্বিক অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ভবিষ্যত অনিশ্চয়তায় পড়েছে, তাই এই দুটি খাতের মেরামত আমরা একা করে এগুতে পারবো না। সেক্ষেত্রে আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড কৃষির প্রতিই রাখতে হবে ভরসা। বর্তমানে আমাদের জিডিপিতে মাত্র ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ অবদান রাখছে কৃষি খাত। কিন্তু একটা সময় ছিলো যখন কৃষি খাতের অবদান ছিলো ৬৫ শতাংশের ওপরে।

করোনাভাইরাসের এই নতুন বাস্তবতায় টিকে থাকতে হলে কৃষি উৎপাদনে সক্ষমতার সর্বোচ্চটুকু কাজে লাগাতে হবে। কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত দেশের বিপুল সংখ্যক যুবক ও মেহনতি মানুষ। করোনা মোকাবিলায় প্রকৃতিগতভাবেই দক্ষিণ এশিয়া বা বাংলাদেশ কিছুটা বাড়তি সুযোগ পেয়েছে। তার একটি হলো বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তরুণ জনগোষ্ঠী এই অঞ্চলে। আর এটি পরীক্ষিত যে তরুণদের ওপর এই ভাইরাসের ক্ষতিকারক প্রভাব তুলনামূলক কম। আর এই তরুণদের উৎপাদনশীলতা তুলনামূলক বেশি। তরুণরাই কৃষির প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে এবং সেটাই করতে হবে। শিল্প-কলকারখানা বৈশ্বিক মন্দার কারণে চাপে পড়লেও কৃষির মূল চালিকাশক্তি যুবকদের যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায় তাহলে বাংলাদেশ সফলতার সঙ্গে এবং শক্তভাবেই এই দুর্যোগে টিকে যাবে। সেক্ষেত্রে চলতি মাঠের ফসল ও আগামী যে ফসল আসছে তার প্রতি বিশেষ নজর দেয়া জরুরি। যেনো অভ্যন্তরীণ উৎপাদিত খাদ্য সামগ্রির দাম নিয়ন্ত্রণে থাকে।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একটি দূরদর্শী নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন দেশের আনাচে কানাচে কোনো জমি যেন খালি না থাকে। যার যা সামর্থ তা অনুযায়ী যেনো ফসল ফলাতে মনোযোগী হয়। বাড়ির আঙ্গিনায় বারোমাসী সবজি, আমদানি নির্ভর মসল্লা ও অন্যান্য ফসল ফলায়। যাতে আমদানি নির্ভরতা কমে আসে। যদি প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা সবাই কার্যকর করে তাহলে অন্তত ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সারা দেশে প্রায় সবকিছু বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এসময় কৃষি সামগ্রি যেমন বীজ, সার, কীটনাশক কৃষকের কাছে পৌঁছে দেয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে এ ব্যপারে দিক-নির্দেশনাও দিয়েছেন। দুর্যোগের এই সময়টাতে সেচকাজে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ ও ডিজেলে দামে প্রত্যক্ষ ভর্তূকির ব্যবস্থা করা যেতে পারে, কৃষিঋণে সুদ ও কিস্তি আপাদত স্থগিতও করা যেতে পারে। মোট কথা যথাসম্ভব উপায়ে কৃষিতে গতি সঞ্চার করতে হবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কৃষক প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে ফসল ফলিয়ে আমদানির ওপর চাপ কমানোর ক্ষেত্র তৈরি করে দিল। কিন্তু কৃষকের ফসল সঠিকভাবে বাজারজাত না হলে পুরো উদ্যোগই ভেস্তে যাবে, মাঝখান থেকে লাভবান হবে যথারীতি মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা। এ ক্ষেত্রে সমবায় বাজার করে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করার উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে কৃষক ন্যায্যমূল্য পায়।

বর্তমানে সারা দেশব্যাপী কার্যত লকডাউন পরিস্থিতি চলছে। সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে। যে জন্য কৃষকের পণ্যের বাজারজাতও মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সারাদেশে মিষ্টির দোকান বন্ধ ও সাধারণ মানুষের মাঝে দুধের চাহিদা কমে যাওয়ায় সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন খামারে ৫ টাকা লিটার দরে দুধ বিক্রি হচ্ছে। পোল্ট্রি খামারিদেরও মাথায় হাত পড়েছে। ৪০টা কেজি দরেও ক্রেতা পাচ্ছেন না। আর লেয়ার বাচ্চা যেখানে বিক্রি হতো ২০ থেকে ৩০ টাকায় সেখানে তা ফ্রিতে কেউ নিচ্ছে না। এসব বিষয়ে এখনই নজর না দিলে খামারিরা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। বাজারে তার বিরূপ প্রভাব পড়বে আগামী মাসেই।

করোনার সংক্রমণ বা বিস্তার নিয়ন্ত্রণে সরকারের নির্দেশনা মেনে সারা দেশের অধিকাংশ মানুষই এখন ঘরে থাকছে, শুধু কৃষক বাদে। রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে কৃষক সারাবছরই মাঠে ঘাম ঝড়িয়ে ফসল ফলায়। কৃষক এগুলো অগ্রাহ্য করে ফসল ফলায় বলেই আমাদের পেটে ভাত যোগে। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে বাম্পার ফলন ফলিয়েও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কৃষক তার মাঠের বিনিয়োগ তুলে আনতে পারছে না। কখনো পাকা টমোটো রাস্তায় ফেলে দিতে হচ্ছে, কখনো-বা আবার ক্ষেতেই রেখে দিতে হচ্ছে বাম্পার ফলন হওয়া আলু। এই পরিস্থিতির মুখে যাতে কৃষককে পড়তে না হয়, তার একটা স্থায়ী বন্দ্যোবস্ত হওয়া দরকার।

করোনায় সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মহাবিপর্যয়ে অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি ও ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে এই মুহূর্তে কৃষককে বাঁচানো ও তাঁকে এগিয়ে নেওয়াই হবে সবচেয়ে সময়োপযোগী উদ্যোগ।

লেখক: সৈয়দ আশিক রহমান

প্রধান সম্পাদক আরটিভি অনলাইন ও সিইও আরটিভি

মন্তব্য করুন

daraz
  • নির্বাচিত কলাম এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
অর্থনীতির সংকট কাটতে শুরু করেছে
‘দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে মানুষ পুষ্টিকর খাবার কাটছাঁট করছেন’
‘জনগণের আমানতকে যারা খেলা মনে করে তাদের মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত’
অর্থনীতিতে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ হচ্ছে রাশিয়া
X
Fresh