রাখাল রাহা ও নাহিদ হাসান নলেজের নামে হওয়া মামলা প্রত্যাহার এবং সাইবার নিরাপত্তা আইন বিলোপের দাবিতে দেশের ৩৮ নাগরিক বিবৃতি দিয়েছেন।
শুক্রবার (৭ মার্চ) তারা এ বিবৃতি দিয়েছেন।
এতে বলা হয়, এ দেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, মুক্তিচিন্তার অধিকার, ভিন্নমত ও সংস্কৃতির সহাবস্থানের লড়াই করে আসছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ সব নাগরিক অধিকার খর্ব করার মধ্য দিয়ে একটি কর্তৃত্ববাদী, বেপরোয়া স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করা হয়েছিল। যা কার্যত ফ্যাসিবাদী শাসনে রূপ নেয়।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, গতবছর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটলেও রাষ্ট্রকাঠামোর নানা পরতে এখনও ফ্যাসিবাদের ছায়া বিদ্যমান। বিশেষ করে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ যেসব নিবর্তনমূলক আইনের মাধ্যমে জনগণের উপর শোষণ-নিপীড়নের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করেছিল, সেসব আইন এখনও বলবৎ রয়েছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা ছিল—ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ মানুষের স্বাধীনতা খর্বকারী ও পীড়নমূলক সব আইন বিলোপের মধ্য দিয়ে মানুষের মর্যাদা সংহত করা হবে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, কিন্তু ঘটছে উল্টোটা। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে সাইবার নিরাপত্তা আইনের নামে প্রতিস্থাপিত করে ফ্যাসিবাদী জামানার পীড়নব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। যার মধ্য দিয়ে বিকাশের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে সামাজিক ফ্যাসিবাদের। বিদ্যমান এসব আইনের সুযোগ নিয়ে মুক্তিকামী নাগরিকদের ওপর আইনিপীড়ন ও গোষ্ঠীবদ্ধ উষ্মা আরোপের সুযোগ পাচ্ছে বিভিন্ন কায়েমী গোষ্ঠী ও ব্যক্তি।
গণমাধ্যমে পাঠানো এই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারী নাগরিকরা লক্ষ্য করছি, আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনের হাতিয়ার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, যেটি ২০২৩ সালে বিলুপ্ত করে পূর্ববর্তী সব নিপীড়নমূলক ধারাগুলো বলবৎ রেখে সাইবার সুরক্ষা নিরাপত্তা আইন নামে নতুন একটি আইন করা হয়; অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশেও সেই আইনের প্রয়োগ বহাল তবিয়তে ঘটে চলেছে।
এতে বলা হয়, সম্প্রতি লেখক ও চিন্তক রাখাল রাহা এবং লেখক ও সংগঠক নাহিদ হাসান নলেজের বিরুদ্ধে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’— এর অভিযোগে সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। কবি সোহেল হাসান গালিব একই আইনে গ্রেপ্তার হয়ে জেল খাটছেন।
বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধিকার, বাকস্বাধীনতার আন্দোলনসহ দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এবং সবশেষ আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জুলাই গণআন্দোলনে রাখাল রাহা ও নাহিদ হাসান নলেজের অনন্য-অগ্রসর ভূমিকা ছিল উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, জুলাই অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের নানা সংস্কার পরিকল্পনাকে তারা দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে নিচ্ছেন, কাজ করছেন সরকারের দুই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে অযাচিতভাবে ধর্ম অবমাননা বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মতো বায়বীয় অভিযোগ তোলার মধ্য দিয়ে তাদের অবদান ও অর্জনকে আজ প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে গোষ্ঠীবদ্ধ উষ্মা উৎপাদনের মধ্য দিয়ে তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলা হচ্ছে। এটি কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক সমাজে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
সবশেষে বলা হয়, আমরা দেশের গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, ভিন্নমত ও বহুত্ববাদী সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী নাগরিকরা এসব ঘটনায় যারপরনাই ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতার সংস্কৃতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে কোনোভাবেই দেশে স্থিতিশীল রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কায়েম হতে পারে না। আর রাষ্ট্রও এমন কোনো আইন জারি রাখতে পারে না, যা ভিন্নমত দমনে ব্যবহৃত হয়, অসহিষ্ণুতাকে উৎসাহিত করে।
আমরা লেখক ও চিন্তুক রাখাল রাহা এবং লেখক ও সংগঠক নাহিদ হাসান নলেজের বিরুদ্ধে হওয়া সাইবার নিরাপত্তা আইনের মামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। সেই সঙ্গে তাদের নামে হওয়া মামলা প্রত্যাহার এবং অবিলম্বে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ নামের ফ্যাসিবাদী জামানার নিদর্শন নিবর্তনমূলক আইনটি সম্পূর্ণভাবে বিলোপের দাবি জানাচ্ছি।
বিবৃতিতে সই করেছেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ (অর্থনীতিবিদ) , কফিল আহমেদ (কবি ও সঙ্গীতশিল্পী), হাসনাত কাইয়ুম (আইনজীবী, আহ্বায়ক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন), সারা হোসেন ( আইনজীবী), কাজী মারুফুল ইসলাম (অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), সুমন সাজ্জাদ (অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়), আ আল মামুন (অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়), সামিনা লুৎফা (শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), সৈয়দ নিজার (শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়), আহমাদ মোস্তফা কামাল (কথাসাহিত্যিক এবং অধ্যাপক), জ্যোতির্ময় বড়ুয়া (আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট), আর রাজী (শিক্ষক, সাংবাদিকতা বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়), আজফার হোসেন (শিক্ষক ও অ্যাক্টিভিস্ট), বখতিয়ার আহমেদ (অধ্যাপক, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ), মোশাহিদা সুলতানা (শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), জি এইচ হাবীব (সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়), মোশরেফা মিশু (সাধারণ সম্পাদক, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি), অধ্যাপক ডা. কাজী রকিবুল ইসলাম (শিশু বিশেষজ্ঞ), আবদুল্লাহ আল ক্বাফী (রাজনৈতিক কর্মী), জামসেদ আনোয়ার তপন (সাধারণ সম্পাদক, উদীচী), মোহাম্মদ আলী হায়দার (মিডিয়া ও থিয়েটারকর্মী), অমল আকাশ (শিল্পী), জলি তালুকদার (শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠক), অলিউর সান (শিক্ষক, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ), বাকী বিল্লাহ (লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী), সীমা দত্ত (সভাপতি, বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্র), মুশাররাত শর্মি হোসেন (শিক্ষক, ইংরেজি বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়), ফেরদৌস আরা রুমী (কবি ও অধিকারকর্মী), আফজাল আহমেদ (অ্যাক্টিভিস্ট), লিটন নন্দী (সাবেক ছাত্রনেতা, সংগঠক, রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়ন), এহসান মাহমুদ (সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক), বাধন অধিকারী (সাংবাদিক), রহমান মুফিজ (কবি ও সাংবাদিক), মোশরেকা অদিতি হক (শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়), আরিফ রহমান (লেখক), মুহাম্মদ কাইউম (চলচ্চিত্র নির্মাতা), মানস নন্দী (সভাপতি, বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন) ও লাবনী আশরাফি।
আরটিভি/আইএম/এআর