নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর হ-য-ব-র-ল
জনসংযোগ দপ্তর কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য জানালাস্বরূপ। যে জানালা দিয়ে শুধু আলোর বিকরণ খেলা করবে তা নয়, বরং প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ও বাইরে, জনমানুষের সাথে সৃজনশীল কর্মকাণ্ড দিয়ে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের ইমেজ সংরক্ষণ ও বৃদ্ধিতেও কাজ করে জনসংযোগের জানালা। কিন্তু এই চিরায়ত কথাগুলোর উজ্জ্বল ব্যতিক্রম জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১৮ বছর পেরিয়ে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর রয়ে গেছে তিমিরেই। গৎবাঁধা প্রেস রিলিজ ও নামকাওয়াস্তে প্রকাশনার মধ্যে আটকে আছে দপ্তরের কর্মকাণ্ড। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নেই কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা। এই দপ্তরের সৃজনশীলতার অভাব যেমন স্পষ্ট তেমনি প্রশাসনের অবহেলার চিত্রও লক্ষনীয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের ১৫-১৬ ফিটের একটি কাচের ঘর নিয়ে দপ্তরটিতে গাদাগাদি করে বসেন এই দপ্তরের কর্মকর্তারা। এলোমেলো অগোছালো প্রকাশনা ছড়িয়ে ছিটয়ে আছে মেঝেতে। ছোট্ট এই দপ্তর কক্ষের চারিদিক যেন হ-য-ব-র-ল।
দপ্তর কক্ষের বেহাল দশা
প্রশাসনিক ভবনের দোতলায় সিঁড়ির ঠিক সামনেই একটা দুই কপাটের বিশাল দরজা। চোকাঠের উপরে লেখা রেজিস্ট্রার দপ্তর। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেই দেখা যায় কাচঘেরা ছোট ছোট ৮টি আয়না ঘর। এরমধ্যে সাতটি রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যবহার করেন। যার যার ঘরের সামনে রেজিস্ট্রার অফিসের সেসব কর্মকর্তার নামফলক রয়েছে। তবে ঢুকেই হাতের বাদিকের প্রথম ঘরটাই হলো জনসংযোগ দপ্তর।
সরেজমিনে দেখা যায়, ১৫-১৬ ফিটের কাচের ঘরে নেই কোনো জানালা। বিদ্যুৎ চলে গেলে নেমে আসে কবরের ঘুটঘুটে অন্ধকার। কাচের দরজা স্লাইড করে দপ্তরে প্রবেশ করতে হয়। দুটো বিশাল স্টিলের আলমাড়ি, তিনটি ফাইল কেবিনেট, একটি বৃহৎ বুকসেল্ফ ও একটি শিকল জড়ানো ফ্রিজ। ভিসি অফিসের আপ্যায়নের খাবার থাকে ফ্রিজে। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রতিদিনের জমানো পত্রিকা, গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নথি ও ফাইল। তার ওপরে ধুলের আস্তর কয়েক স্তরে জমা পড়ে আছে। এরই মধ্যে তিনটি ঢাউস টেবিলে এই দপ্তরের তিন কর্মকর্তার বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অফিস টেবিলের সামনে ছোট দুটি ময়লা চেয়ারও আছে। দপ্তরে কোনো অতিথি কিংবা সাংবাদিকরা এলে এখানেই বসেন। মাথার ওপরে খটখট শব্দে ঘুরছে দুটি সিলিং ফ্যান।
এ সময় দপ্তরে কর্মরত জনসংযোগ তথ্য ও প্রকাশনা কর্মকর্তা মো. রেজাউদ্দৌলাহ প্রধানের কাছে দপ্তরের অস্বাস্থ্যকর ও রুচিহীন পরিবেশ নিয়ে জানতে চাইলে তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বরং দপ্তর প্রধান ও প্রশাসনের কাছে জানার জন্য পরামর্শ দেন।
তীব্র জনবল ও আসন সংকট
বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের অর্গানোগ্রামে সাতটি পদের অনুমোদন থাকলেও নিয়োগ পেয়েছেন মাত্র পাঁচজন। এর মধ্যে দপ্তরে বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র তিন জন। বাকি দুজনকে নিয়োগের পরপরই বদলি করা হয়েছে অন্যত্র। অফিস সহায়ক কাম ডাটা প্রসেসর পদে নিয়োগপ্রাপ্ত রাজিবুল হাসান রাজিবকে সাবেক উপাচার্য ড. সৌমিত্র শেখরের প্রশাসন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে বদলি করেন। আর পিওন পদে যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাকে দপ্তরের কেউ কোনদিন চোখের দেখাও দেখেতে পাননি। এসব বদলির নির্দেশ উপাচার্যের অনুমোদনে রেজিস্ট্রার স্বাক্ষর করে থাকেন।
বদলিসংক্রান্ত এসব বিষয়ে প্রশাসনিক অবহেলা ও ব্যক্তিগত কারণ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রেজিস্ট্রার ড. মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘এগুলো উপাচার্যের নির্দেশক্রমে বা অনুমোদনক্রমে করা হয়ে থাকে। রেজিস্ট্রারের ইচ্ছায় বা স্বার্থে এগুলো করার সুযোগ থাকে না।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, কোনো দপ্তরে তীব্র জনবল সংকট থাকার পর নিয়োগ দিয়েও যদি সেই জনবল বদলি করে দেওয়া হয়, তাতে প্রমাণ হয় যে ওই দপ্তরকে প্রশাসন কতটা অবহেলা করেছে।
জনবল সংকটের পাশাপাশি এখানে আসনও সংকটও তীব্র। একটি মাত্র দপ্তর কক্ষে বর্তমানে সকল কর্মকর্তার বসার ব্যবস্থাও করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সম্প্রতি দপ্তরটি ঘুরে দেখা যায়, অতিথির ছোট চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছেন দপ্তরটির অতিরিক্ত পরিচালক এস এম হাফিজুর রহমান। তিনি মূলত ২০১১ সালে জনসংযোগ তথ্য ও প্রকাশনা পদে ভিসি অফিসে যোগদান করেছিলেন। এরপর তিনি সাবেক উপাচার্য এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমানের সময় থেকে চলতি মাস অব্দি পিএস টু ভাইস-চ্যান্সেলর পদে অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলেন। ভিসি দপ্তরের সাজানো গোছানো শীতাতপনিয়ন্ত্রিত পিএস কক্ষে বসেই কাজ করতেন তিনি। কিন্তু গত ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পর তার সে স্বাচ্ছন্দময় জীবনেও ছেদ পড়েছে, হঠাৎ ছন্দপতনে তিনি আছেন বেকায়দায়। দীর্ঘদিন পরে তাই প্রশাসনের কাছে পিএস এর দায়িত্ব থেকে অব্যাহিত চেয়ে ফিরেছেন তার আদি দপ্তরে। কিন্তু তিনি ফিরে এলেও দপ্তরে তার বসার ব্যবস্থা করেনি প্রশাসন। অনেকটা নিরুপায় হয়ে দপ্তরে রাখা অতিথির আসনে বসেই অফিস করছেন তিনি।
আসন সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, জনবল, অবকাঠামো ও বিভিন্ন ইকুইপমেন্টের অভাব আমাদের রয়েছে। কোনো সময়ই আমাদের ওপর সুদৃষ্টি পাইনি। নিজেরা ঠিকমতো বসতে যেমন পারছি না, অতিথিরা এলে ভোগান্তি আরও বাড়ে। এই দপ্তরের কার্যক্রমের মাধ্যমে অনেক প্রডাক্টিভিটি আনার সুযোগ আছে। তবে বিভিন্ন সূচকে পিছিয়ে থাকায় কাজ করতে আমাদের অসুবিধা হয়।
পরিচালক পদ খালি ৭ বছর
নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু ২০০৬ সালে। চারটি বিভাগ ও কয়েকটি দপ্তর নিয়ে শুরু হয় এই বিদ্যায়তনের পথচলা। এই পথচলায় জনসংযোগ দপ্তর সৃষ্টি হয় ২০১৬-১৭ সালের প্রণীত বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্গানোগ্রামে। সেই অর্গানোগ্রাম অনুসারে দপ্তরটির জন্য ৭টি পদ তৈরি করা হয়। বিভিন্ন সময়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মধ্যদিয়ে জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা অফিসার পদে একজন, জনসংযোগ কর্মকর্তা পদে একজন, ফটোগ্রাফার পদে একজন, অফিস সহায়ক কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে একজন, পিওন পদে একজন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এখনও অর্গানোগ্রামে থাকা উপপরিচালক, অতিরিক্ত পরিচালক ও পরিচালক পদ দীর্ঘসময় ধরেই শূন্য রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য সকল দপ্তর যেখানে পরিচালক দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে সেখানে জনসংযোগ দপ্তরের পরিচালক পদে নিয়োগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ নেই। পরিচালকহীন এই দপ্তর যেন মাঝিহীন নৌকার মতো দিগবিদিক ভাসছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জিহাদুজ্জামান জিসান বলেন, সাংবাদিকরা মূলত তাদের কাজের জন্য জনসংযোগ দপ্তরের দিকে মুখাপেক্ষী। অথচ দপ্তরটি আপডেটেড না। বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও সংকট ও সমস্যায় জর্জরিত দপ্তরটি। অন্য দপ্তরগুলোতে যেভাবে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত পরিচালক কিংবা শিক্ষকদের অতিরিক্ত/ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্ব প্রদানের মধ্যদিয়ে দপ্তরকে সচল ও গতিশীল করে রাখা হয়েছে, এখানেও সেভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, জনসংযোগ দপ্তরকে গতিশীলভাবে পরিচালনার জন্য আরও জনবল প্রয়োজন। এছাড়া যেসব জনবল নিয়োগ দিয়ে বদলি করা হয়েছে তাদের বিকল্পও এই দপ্তরে ফিরিয়ে না দিলে দপ্তর সবল হতে পারবে না।
জনসংযোগ দপ্তরের হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি নিয়ে জানতে পাইলে বিশ্বিবদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম আরটিভি নিউজকে বলেন, এই দপ্তরের বিষয়ে প্রশাসন অবগত রয়েছে। কীভাবে এখানে আরও গতিশীলতা আনা যায় এ বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নেব।
আরটিভি/এমকে
মন্তব্য করুন