ফিরে দেখা ২০২৪
বিএনপির পালে হাওয়া, রয়েছে নানামুখী চ্যালেঞ্জ
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। দলীয় নেতাকর্মীদের রেখে স্বৈরাচার তকমা পাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে যান ভারতে। এতে রাতারাতি পাল্টে যায় বিএনপির ভাগ্য। ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্তি পান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। একই সঙ্গে কারাগার থেকে মুক্তি পান দলটির কয়েক হাজার নেতাকর্মী। বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে দীর্ঘ সময় বিদেশে অবস্থান নেওয়া দলটির নেতাকর্মীরাও দেশে ফিরতে থাকেন।
দলটির পছন্দের লোকজন দায়িত্ব পান রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে। বলা যায়, আগামী দিনে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে বিএনপি। সবমিলিয়ে অসাধারণ ও অকল্পনীয় একটি বছর পার করছে দলটি।
দেখা যাচ্ছে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দল গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন বিএনপি নেতারা। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও হচ্ছে সভা-সমাবেশ। বলা যায়, স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের ১৬ বছরে কোণঠাসা হয়ে পড়া দলটির পালে হাওয়া লেগেছে। তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে মাঠের রাজনীতিতে। তবে রাষ্ট্র পুনর্গঠনে দলটির সামনে এখনও রয়েছে নানামুখী চ্যালেঞ্জ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি এখন সংগঠন গুছিয়ে নিয়ে এসে নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। তবে বিগত দিনে দেওয়া ৩১ দফার রূপরেখা যে কথার কথা নয়, তা প্রমাণ করতে হবে কাজের মাধ্যমে। তাদের সংস্কার প্রস্তাবগুলো নতুন আঙ্গিকে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে।
বিএনপির এখন সম্ভাব্য সুদিন। একই সঙ্গে তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ায় চ্যালেঞ্জের মুখেও পড়েছে তারা। বিএনপি বড় রাজনৈতিক দল। তারা অতীতেও ক্ষমতায় ছিল। আগামী নির্বাচনে প্রতিপক্ষ কে হবে, সেই প্রস্তুতি তাদের নিতে হবে। আর নির্বাচনের সময় সীমা নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্কের ভেতর দিয়েই বিএনপিকে তার রাজনীতির কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।
যদিও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার করে যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন দেবে বলে আশা করছে দলটি।
সম্প্রতি এক ভিডিওবার্তায় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, আগামী নির্বাচনে প্রতিপক্ষ নেই এটি ভাবা যাবে না; অতীতের যেকোনো নির্বাচনের থেকে এই নির্বাচন হবে অনেক কঠিন। তাই নিজেদের সেভাবে প্রস্তুত করতে হবে। নেতাকর্মীদেরকে ৩১ দফার পক্ষে জনসমর্থন নেওয়ার জন্য কাজ করতে হবে। জনগণের মন জয়ের জন্য কাজ করতে হবে।
নতুন চ্যালেঞ্জে বিএনপি
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ভিন্ন রকম এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। আগামী নির্বাচনের আগে রাষ্ট্র সংস্কারের ব্যাপারে নিজেদের প্রস্তাবনা ও দলীয় নেতাকর্মীর কর্মকাণ্ড দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে দলটিকে। রাজনীতিতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ এখন কঠিন সংকটে। এবারের নির্বাচনে সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতায় নামতে হতে পারে বিএনপিকে। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলকে নিয়ে ইসলামী ফ্রন্ট এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র-তরুণদের সম্ভাব্য নতুন দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হতে পারে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দলটিকে।
একই সঙ্গে বিএনপিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে নিয়ে যেতে হবে দেশকে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, দেশের সামরিক-বেসামরিক শক্তি ও সুশীল সমাজের সমর্থন আদায়ও করতে হবে। সঙ্গে রয়েছে লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ।
দলটির নেতারা বলছেন, সমমনা দলগুলোকে নিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের নতুন প্রস্তাব দিয়ে দেশি-বিদেশিদের আস্থা অর্জনে তারা আশাবাদী। একই সঙ্গে তারা দলকে সুসংগঠিত করে নতুন সব চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করবেন। আগামী নির্বাচনে জনগণের সমর্থন নিয়ে বিপুল ভোটে ক্ষমতায় আসবেন।
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে আন্দোলন করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। দ্বাদশ সংসদের একতরফা নির্বাচনের ছয় মাসের মাথায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকারের পতনে বদলে যায় দৃশ্যপট। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারামুক্ত হন। রাজনৈতিক মামলায় দলের কারাবন্দি সর্বস্তরের নেতাকর্মীরাও বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে দলটির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠছে। এতে দলটি আবার জনপ্রিয়তা হারানোর চ্যালেঞ্জে পড়েছে। যদিও দলটির হাইকমান্ড কঠোর অবস্থান নিয়ে অনেককে বহিষ্কার করেছেন।
চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বিএনপি
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর তার স্ত্রী খালেদা জিয়া দলটির হাল ধরেন। তার নেতৃত্বে তিনবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে বিএনপি। অন্তর্বর্তী সরকার তাকে মুক্তি দিলেও রাজনীতিতে নেই তিনি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তার ছেলে তারেক রহমান লন্ডন থেকে দল পরিচালনা করছেন। এতে সক্রিয় উপস্থিতির শূন্যতা পূরণ হচ্ছে। দলের নেতারাও দাবি করছেন, এখন ডিজিটাল যুগে সশরীরে উপস্থিতির কাজ ভার্চুয়ালি সম্ভব হচ্ছে।
১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর প্রথমবার সংকটে পড়েছিল বিএনপি। আশির দশকে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর দ্বিতীয়বার গভীর সংকটে পড়ে দলটি। ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের সময় খালেদা জিয়াসহ বিপুল সংখ্যক শীর্ষ নেতা কারাবন্দি হলে দলটি তৃতীয় দফা নেতৃত্ব সংকটে পড়ে। তিনবারই ভাঙনের মুখে পড়েছিল দলটি। তবে এবার তারেক রহমানের নেতৃত্বে দলটি সুশৃঙ্খলভাবে সংগঠিত হয়েছে।
বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও রাজনীতিতে ফেরা
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুদকের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে পাঠানো হয় বেগম খালেদা জিয়াকে। দুই বছরের বেশি সময় কারাভোগের পর করোনা মহামারির প্রেক্ষাপটে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার শর্তসাপেক্ষে তাকে সাময়িক মুক্তি দেয়। তারপর বিভিন্ন সময় তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হলেও শর্ত অনুযায়ী তাকে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখা হয়েছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। প্রায় সাত বছর পর গত ৭ আগস্ট বিএনপির জনসভায় খালেদা জিয়ার ভিডিও রেকর্ডিং বক্তব্য প্রচার করা হয়। আর এক যুগ পর গত ২১ নভেম্বর সেনাকুঞ্জে অনুষ্ঠিত সশস্ত্র বাহিনী দিবসে যোগ দেন তিনি।
গণমাধ্যমে তারেক রহমানের ফেরা
আইনের দৃষ্টিতে পলাতক থাকা অবস্থায় তারেক রহমানের বক্তব্য বা বিবৃতি প্রচারে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাসরিন সিদ্দিকী একটি রিট দায়ের করেন। পরের দিন হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। তারেক রহমানের সব ধরনের বক্তব্য ও বিবৃতি গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এটি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও নির্দেশ দেওয়া হয়। গত বছরের আগস্টে রিট আবেদনকারী সম্পূরক আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৮ আগস্ট এক আদেশে হাইকোর্ট তারেক রহমানের বক্তব্য, বিবৃতি, অডিও ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে সরাতে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বিটিআরসিকে নির্দেশ দেয়। কিন্তু ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের কিছুক্ষণ পর গণমাধ্যমগুলো তারেক রহমানের বক্তব্য ও ভিডিও প্রচার শুরু করে। ফলে, প্রায় ১০ বছর পর গণমাধ্যমে ফিরে আসেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
বাধাহীন পরিবেশে রাজনীতিতে বিএনপির ফেরা
বিগত এক যুগের বেশি সময় অর্থাৎ ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত যে কোনো রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পুলিশ প্রশাসনের অনুমতি নেওয়া বিএনপির জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। অনেক সময় আবেদন করেও পাওয়া যেত না অনুমতি। আবার দেওয়া হলেও সেটা কর্মসূচি শুরুর এক কিংবা দুই ঘণ্টা আগে। পাশাপাশি পুলিশের বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কর্মসূচি শেষ করা, কর্মসূচির মাঝপথে হামলা হওয়ার ভয় ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সেই হামলায় উল্টো আসামি করা হতো বিএনপির নেতাকর্মীদের। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপির সেই অবস্থা কেটে গেছে। এখন সারাদেশে বাধাহীন পরিবেশে কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে দলটি।
নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ও ভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি
বিএনপির নীতিনির্ধারক নেতাদের মতে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সফলতার মধ্য দিয়ে বিএনপির ১৫ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। ছাত্র-জনতার নির্দলীয় নেতৃত্ব মেনে নিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়েছিল দলটি। এ আন্দোলনে নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির উত্থান ঘটেছে। রাজনৈতিক দলগুলো তা মেনেও নিয়েছে।
তাদের মতে, ফ্যাসিবাদী বনাম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের যে মেরূকরণ ছিল, তা শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার নতুন মেরূকরণ তৈরি করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে সামনে এসেছে।
দেশে রাজনৈতিক বিভাজন স্পষ্টত। একদম খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষও আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপিকে তুলনা করছে। বিশেষ করে দুই দলের নেতাকর্মীর কার্যক্রমকে অনেকেই একই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বলে অভিহিত করছেন। এ পরিস্থিতিতে সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও দখলদারির অভিযোগগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে শুরু করেছে বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান জানান, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে যে দলটির সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর, সেই দলটিই আজ আবার গণতন্ত্রের নতুন দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে এগিয়ে যাবে নতুন প্রজন্মের জন্য আগামীর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে। অদূর ভবিষ্যতে এটি হবে এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে থাকবে না ক্ষমতার দম্ভ অথবা আস্ফালন, থাকবে না অত্যাচার-নির্যাতন, থাকবে না দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি। বিএনপি অতীতের ভুলভ্রান্তি দূর করে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
গণঅভ্যুত্থানে লাভবান বিএনপি
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে তিনটি বড় গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনীতির বাঁক বদল ঘটেছে, তার সবগুলোতে দৃশ্যত লাভবান হয়েছে বিএনপি। এই তিনটি ঘটনা ঘটেছে ১৯৭৫ সাল, ১৯৯০ সাল এবং ২০২৪ সালে। এসব গণঅভ্যুত্থানের একটির মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছেন, আরেকটি গণঅভ্যুত্থানের পরে নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে। আরেকটির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সাঈদ ইফতেখার বলছেন, দুটো গণঅভ্যুত্থানের পরে ‘রাজনৈতিক শূন্যতার’ সুবিধা পেয়েছে বিএনপি। প্রতিটি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগ অত্যন্ত নেতিবাচক হিসেবে জনগণের কাছে প্রতিভাত হয়েছে। সে সুযোগ বিএনপি পেয়েছে।
সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান ১৯৭৫
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার আগে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অনেকের মনে মারাত্মক অসন্তোষ ছিল। একদলীয় শাসন ব্যবস্থা, যেটি ‘বাকশাল’ হিসেবে পরিচিত, প্রবর্তনের মাধ্যমে মুজিব-বিরোধী মনোভাব প্রবল হয়ে ওঠে। শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর তৎকালীন বাংলাদেশে পরিষ্কার রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। সেটি পূরণ করার জন্য ‘বিশ্বাসযোগ্য ও জনপ্রিয়’ কোন দল ছিল না।
হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতাচ্যুত হবার পরে বিএনপি নামক কোন রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ছিল না। তখন ক্ষমতায় এসেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ, যিনি আওয়ামী লীগেরই নেতা ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে বিদ্রোহ হয়। খালেদ মোশাররফের এই অভ্যুত্থানকে ভারতীয় আধিপত্যবাদের একটি ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করে মুজিব-বিরোধীরা।
ওই সময় অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিল তৎকালীন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও জাসদ নেতা কর্নেল আবু তাহের। প্রধানত তার পরিকল্পনায় জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়। ক্যান্টনমেন্টে আবু তাহেরের নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকলেও বাইরে সিপাহী-জনতার মিছিল এবং বিক্ষোভ সকাল দশটার আগেই জাসদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এরপর বন্দীদশা থেকে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন।
গণঅভ্যুত্থান ১৯৯০
১৯৮০’র দশকে তৎকালীন সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আন্দোলন করে। তাদের সাথে অন্যান্য রাজনৈতিক দলও ছিল। দেখা গেল, এরশাদের পতনের পরে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে যখন প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তখন ক্ষমতায় আসে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেবার কারণে জনগণের মধ্যে তাদের নিয়ে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। তখন এরশাদ-বিরোধী বড় রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছিল যে স্বৈরাচার সরকারের আমলে কোন নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। কিন্তু সবাইকে হতবাক করে দিয়ে আওয়ামী লীগ ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে এইচএম এরশাদ সরকারের সঙ্গে তাদের একটি সমঝোতা হয়েছিল বলে জানা যায়। তখন এরশাদ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন মওদুদ আহমদ, যিনি পরবর্তীতে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ যদি ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ না নিত তাহলে এরশাদের পতন আরো আগেই ঘটানো সম্ভব হতো। এ বিষয়টি বিএনপিকে রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছিল এরশাদের পতনের পর। এর ফলে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি ক্ষমতায় আসে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ২০২৪
২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনা ভারত পালিয়ে যাওয়ার পরে যে দুটো রাজনৈতিক দল এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে লাভবান হয়েছে তারা হচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ স্বয়ংক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের দখলে চলে গেছে। ৫ আগস্টের পরে বেশ দ্রুততার সঙ্গে বিএনপি নেতা খালেদা জিয়াকে মুক্তির আদেশে স্বাক্ষর করেন রাষ্ট্রপতি। এরপর বিএনপির বেশ কিছু সিনিয়র নেতা জেল থেকে দ্রুত ছাড়া পান। অনেকে মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।
লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপি নেতা তারেক রহমানের বক্তব্য বিবৃতি শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে গণমাধ্যমে প্রচার করা নিষিদ্ধ ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারিত হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের এখন আর পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে না। এসব কিছু বিএনপিকে তাৎক্ষণিকভাবে রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছে।
গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের শাসনামলকে ফ্যাসিবাদের তুলনা করেছে বিএনপি। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ও ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরে বিএনপির দেওয়া ‘ফ্যাসিবাদ’ তকমা অনেকেই ব্যবহার করছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে।
আওয়ামী লীগকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ
আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলকে আগামী নির্বাচনে চায় বিএনপি- প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এমন বক্তব্যের পর রাজনীতির মাঠে তোলপাড় চলছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগের বিষয়টি নিয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে দেখা দিয়েছে বিভক্তি।
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ নিয়ে বিএনপিকে জড়িয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য ঠিক নয়। বিএনপি কখনোই আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে সুপারিশ কিংবা প্রস্তাব দেয়নি।
জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র শামান্তা শারমিন জানান, বিচারের আগে আওয়ামী লীগের কোনো স্থান নেই। এর আগে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন, ভোটে আনার কথা বলা অপরাধ। আওয়ামী লীগ যদি সামাজিকভাবে ফিরতে চায়, তবে গণহত্যা স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে হবে।
যদিও কিছুদিন আগে গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব বলেছিলেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি আওয়ামী লীগ বা কোনো দলকেই নিষিদ্ধ করার পক্ষে নন। জামায়াতকে নিষিদ্ধের উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, এটি ন্যায়সংগত সিদ্ধান্ত ছিল না। ফলাফল কী হয়েছে? জামায়াত এখন রাজনীতিতে ফিরেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মুহূর্তে নির্বাচনের দাবি বিএনপির চাহিদা হতেই পারে। কিন্তু আপামর জনতার পক্ষ থেকে গত ১৫ বছরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া রাষ্ট্রকেও পুনর্গঠনের চাহিদা রয়েছে।
এ দিকে নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এখনই চাপ দেওয়ার বিষয়টিকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বড় একটি অংশ ভালো চোখে দেখছে না। এর বিপরীতেও রয়েছে নানা যুক্তি তর্ক।
এখন সময়ই বলে দেবে নির্বাচন নিয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের শক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক শক্তির এই বিরোধ কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে।
তবে বিএনপির পালে যে হাওয়া লেগেছে তাতে আগামী দিনে রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাদের কাধে আসলেও সেখানে যেন সুন্দর আর পরিচ্ছন্ন রাজনীতি করে দলটি, সেই প্রত্যাশাই করে সাধারণ জনতা।
আরটিভি/এমকে
মন্তব্য করুন