টিকটক ট্রলে দুর্বিষহ যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশি নারীদের জীবন

আরটিভি নিউজ

বুধবার, ০৩ এপ্রিল ২০২৪ , ০৩:২৮ পিএম


টিকটক ট্রলে দুর্বিষহ যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশি নারীদের জীবন
টিকটকে ট্রলের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছেন সুলতানার (ছদ্মনাম) মতো প্রবাসী বহু বাংলাদেশি নারী। ছবি : বিবিসি

যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় একটি যোগাযোগমাধ্যম টিকটক। বিশেষ করে রক্ষণশীল পরিবারের নারীরা এটি ব্যবহার করে বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলে থাকেন। তাদের বেশিরভাগ মতামতই নারীবাদকেন্দ্রিক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশি নারীদের স্বাধীন মত প্রকাশের ঠিক এই ব্যাপারটিই পছন্দ নয় হাসান সাঈদ নামে ফ্রান্স প্রবাসী বাংলাদেশি এক তরুণের। বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাংলাদেশি নারীদের অনলাইনে বুলিং করায় মত্ত সে। তার ভয়াবহ বুলিংয়ের শিকার হয়ে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে প্রবাসী বহু নারীর জীবন। 

বিজ্ঞাপন

যুক্তরাজ্যে এমন বেশ কয়েকজন নারীর সন্ধান পেয়েছে বিবিসি। হাসানের ট্রলের শিকার ওই নারীদের অনেকে সংবাদমাধ্যমটিকে জানিয়েছেন, তাদের মানসিক অবস্থা এতটাই বিপর্যস্ত যে মাঝেমধ্যেই আত্মহত্যার চিন্তা নাড়া দিয়ে উঠছে মাথায়।  

মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি। তাতে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের পুলিশ এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না ভুক্তভোগী ওই নারীরা। সুযোগে ক্রমেই আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে প্যারিসের উপকণ্ঠে বসবাসরত বাংলাদেশি ওই তরুণ। এমনকি অনেক নারীকে ধর্ষণ ও হত্যারও হুমকি দিচ্ছে সে।  

বিজ্ঞাপন

যুক্তরাজ্যের ইয়র্কশায়ারে বসবাস করেন সুলতানা (ছদ্মনাম)। তিনি জানান, নারীবিদ্বেষ ও বাজে সম্পর্কের বিষয়ে টিকটকে আওয়াজ তোলেন তিনি।  ২০২১ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রলের শিকার হন তিনি। মূলত ট্রলের শিকার হওয়া তার এক বন্ধুর পক্ষে কথা বলার পর তিনিও হাসানের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন।

হাসানের ট্রল এতটাই ভয়ঙ্কর ছিল যে সামাজিকভাবে হেয় হয়ে মানসিকভাবে একেবারে ভেঙে পড়েন সুলতানা। নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছিল, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। আমি কান্না করেছি। খেতে পারিনি, ঘুমাতে পারিনি। মনে হচ্ছিল, এখানে আর থাকতে চাই না।’

তিনি বলতে থাকেন, ‘আমি কাজে ছিলাম। এ সময় আমার কয়েকজন টিকটক ফলোয়ার আমাকে খুদে বার্তা পাঠান। তারা জিজ্ঞাসা করছিলেন, আমি হাসানের সেই ভিডিওগুলো দেখেছি কি না। সেই ভিডিও ও পোস্টগুলোতে লোকজন কমেন্ট করছিল। আমাকে নিয়ে তারা হাসাহাসি করছিল। এ ধরনের নিপীড়ন দুই বছর ধরে চলে। এটা এমন এক অভিজ্ঞতা, যা তিনি কখনো ভুলতে পারব না।’

বিজ্ঞাপন

সুলতানা বলেন, ‘আমার মানসিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। সুস্থ হতে থেরাপি নিয়েছি। ট্রলের ঘটনাগুলো আমার অসুস্থতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি তা আমাকে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিস-অর্ডারের দিকে ঠেলে দিয়েছে।’

বিজ্ঞাপন

ভুক্তভোগীরা বলেন, নারীদের স্বাধীন মতামত প্রকাশ পছন্দ করেন না রক্ষণশীল অনেক পুরুষ। নারীদের যেকোনোভাবে থামিয়ে দিতে চান তারা। এ জন্য অনলাইন বুলিংকে বেছে নেয় তারা। হাসান সাঈদ নামে প্যারিস প্রবাসী ওই যুবক ওই দলভুক্ত একজন। 

হাসান মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে তার শিকারদের ব্যক্তিগত ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করেন। এরপর সেগুলো গ্রিন স্ক্রিনে নিয়ে ট্রল ভিডিও তৈরি করেন। পরবর্তীতে টিকটক লাইভে এসে ভুক্তভোগী নারীদের চেহারা ও অন্যান্য বিষয়ে মজা করেন। নারীদের ধর্ষণ ও হত্যার হুমকিও দেন তিনি।

হাসানের আরেক শিকার মাসুমা নামে যুক্তরাজ্যের ওয়েলসের এক নারী। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি তিনি টিকটিকে রান্নার ভিডিও বানান এবং অনলাইনে একটি দোকান চালান। একদিন এমন একটি লাইভ চলার সময় হাসান সেখানে উপস্থিত হন এবং তাকে তার অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানাতে বলেন। মাসুমা তাতে রাজি না হলে হাসান তাকে ‘ফাঁসিতে ঝোলানোর’ হুমকি দেন।

এরপর মাসুমা একটি ভিডিও শেয়ার করে অন্যদের এ যুবকের বিষয়ে জানান এবং তার একাউন্টের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করার আহ্বান জানান। তাতে হাসান আরো রেগে যান এবং তাকে নিয়ে আজেবাজে ভিডিও বানানো শুরু করেন। একটি ভিডিওতে মাসুমাকে দেখিয়ে বলেন যে তিনি একজন যৌনকর্মী।

মাসুমার অনুসারীরা রিপোর্ট করলে টিকটিক থেকে তার ওই ভিডিও সরিয়ে ফেলা হয়। তবে ওই ঘটনা জীবনের বড় এক ক্ষতি করে গেছে বলে মনে করেন এ তরুণী।

বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু নারীরাই নয়, হাসানের অনলাইন বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন পুরুষরাও। এসব ট্রলের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা বিভিন্নভাবে প্রতিকার পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। এমনই একজন কামরুল ইসলাম। হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব বুলিং বন্ধ করার আহ্বান জানান এ ভুক্তভোগী। এতে উল্টো ক্ষিপ্ত হয়ে কামরুলের পুরো পরিবার নিয়ে ট্রল শুরু করেন হাসান।

এসব ভিডিও সরাতে পরে কামরুল টিকটক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তারা তাকে সাফ জানিয়ে দেন, এসব তাদের কমিউনিটি গাইডলাইন লঙ্ঘন করেনি। তাই ভিডিওগুলো সরানো হবে না।

কামরুল এরপর পুলিশের কাছেও অভিযোগ করেন। এতেও ট্রল না থামায় তিনি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্যারিসে যুক্তরাজ্যের দূতাবাসে যোগাযোগ করেন।

দূতাবাস ফরাসি আইনজীবী ম্যাথিউ ক্রোইজেতের সঙ্গে কামরুলের যোগাযোগ করিয়ে দেয়। কামরুলের কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে প্যারিসের সরকারি কৌঁসুলির দপ্তরে অভিযোগ করেন এ আইনজীবী। কিন্তু এ মামলার কোনো রায় এখনো হয়নি।

মামলার হালনাগাদ তথ্য জানতে প্যারিসের কেন্দ্রীয় পুলিশ স্টেশন ও আদালতে যোগাযোগ করে বিবিসি। কিন্তু এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত কোনো প্রতিউত্তর পাওয়া যায়নি।

 

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন
Advertisement
Advertisement

Loading...


© All Rights Reserved 2016-2025 | RTV Online | It is illegal to use contents, pictures, and videos of this website without authority's permission