বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ , ০২:৩০ এএম
বৈশ্বিক দুর্নীতির ধারণা সূচকে সর্বনিম্ন স্কোর (খারাপ থেকে ভালো) পাওয়া দেশগুলো মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪তম এবং দুই ধাপ পিছিয়ে (ভালো থেকে খারাপ) বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে ১৫১তম। গত বছর এ সূচকে ১৪৯তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। অর্থাৎ দুর্নীতি মূল্যায়নের দুটি সূচকই বলছে, দুর্নীতি বাড়ছে। এটি খুবই বিব্রতকর বলে জানিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)।
মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) পরিচালিত ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক (করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স বা সিপিআই) ২০২৪’ এ ১৮০টি দেশ নিয়ে এ র্যাঙ্কিং প্রকাশ করা হয়েছে। এ সময় সারা বিশ্বে একযোগে দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশ করা হয়। এতে সিপিআই এ সর্বোচ্চ স্কোর পেয়েছে ডেনমার্ক। সর্বনিম্ন স্কোর পেয়েছে সাউথ সুদান।
টিআই-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ১৪তম। আগের বছর যা ছিল দশম। বাংলাদেশের চার ধাপ এগিয়ে যাওয়ার কারণ এ দেশে দুর্নীতি কমেছে, তা নয়। বরং অবস্থা খারাপ হয়েছে। গত বছর বেশি নম্বর পেয়েও বাংলাদেশের অবস্থান ছিল পেছনে। এ বছর কম নম্বর পেয়েও বাংলাদেশ ৪ ধাপ এগিয়েছে। এর কারণ হলো-অন্যান্য কয়েকটি দেশের অবস্থান খারাপ হয়েছে। ফলে তারা বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়েছে। এতে বাংলাদেশ সামনে এগিয়েছে।
বাংলাদেশের অবস্থান থেকে আমাদের জন্য তিনটি উদ্বেগজনক বিষয় উঠে এসেছে। প্রথমত, বাংলাদেশ এখন সেই দেশগুলোর মধ্যে পড়ছে, যারা দুর্নীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, যেসব দেশ ৫০-এর নিচে স্কোর পেয়েছে, তাদের ‘গুরুতর দুর্নীতিগ্রস্ত’ ধরা হয়। বাংলাদেশ সেই তালিকায় রয়েছে। তৃতীয়ত, আমাদের স্কোর বৈশ্বিক গড় ৪৩-এর তুলনায় ২০ পয়েন্ট কম। ফলে বাংলাদেশকে ‘অত্যন্ত গুরুতর দুর্নীতিগ্রস্ত’ দেশের তালিকায় ফেলা হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সূচকে দুর্নীতির ধারণার মাত্রাকে ‘০’ থেকে ‘১০০’ এর স্কেলে নির্ধারণ করা হয়। ‘০’ স্কোরকে দুর্নীতির কারণে সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত এবং ‘১০০’ স্কোরকে দুর্নীতির কারণে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত বা সর্বাধিক সুশাসিত বলে ধারণা করা হয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) বরাত দিয়ে ইফতেখারুজ্জামান জানান, ১০০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ২৩, যা গতবারের চেয়ে ১ পয়েন্ট কম। গত বছর বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২৪। ২০১২ সালের পর এবার দুর্নীতি সূচকে সবচেয়ে কম স্কোর পেয়েছে বাংলাদেশ। ভুটান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের স্কোর কমেছে।
তিনি আরও বলেন, টিআইবির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা গভীর উদ্বেগজনক বলেই প্রতীয়মান হয়। আর এ বছর স্কোর ও উচ্চক্রম অনুযায়ী অবস্থানের অবনমন হয়ে প্রমাণ করে যে, বিগত ১৩ বছর কর্তৃত্ববাদী সরকার মুখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললেও বাস্তবে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে, লালন করেছে, এমনকি দুর্নীতি সংঘটনে সহায়তা ও অংশগ্রহণ করেছে।
এর প্রভাবে যথেচ্ছ লুটপাট, দুর্নীতিবাজদের রাষ্ট্রীয়ভাবে তোষণ, আইনের সঠিক প্রয়োগ না করা এবং সার্বিক কাঠামোগত দুর্বলতায় বাংলাদেশের অবস্থানের ক্রম অবনতি হয়েছে। অথচ দুর্নীতিবিরোধী বাগাড়ম্বর ব্যতীত এ নিয়ে পতিত আওয়ামী সরকারের কোনো বিকার বা চিন্তা দেখা যায়নি।
এমনকি দুর্নীতি দমনে দায়িত্বপ্রাপ্ত দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের প্রকৃত ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তদুপরি দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে এবারও বাংলাদেশের অবস্থান ও স্কোর যথারীতি বিব্রতকরভাবে আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বনিম্ন।
সিপিআই সূচকের বিশ্লেষণ বলছে, বিগত ২০২৪ সালে বাংলাদেশের স্কোর গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অর্থাৎ স্কোর বিবেচনায় বাংলাদেশের নিম্নমুখী যাত্রা সুস্পষ্ট। ২০১২ সালে থেকে সূচকে ব্যবহৃত ১০০ ছেলে বাংলাদেশের স্কোর ২০২২ সাল পর্যন্ত ‘২৫ থেকে ২৮’ এর মধ্যে আবর্তিত হয়েছে। ২০২৩ সালে স্কোর এক পয়েন্ট অবনমন হয়ে ২৪ এবং ২০২৪-এ আরও এক পয়েন্ট অবনমন হয়ে ২৩ হয়েছে।
সিপিআই অনুযায়ী, ১০০-এর মধ্যে ৯০ স্কোর পেয়ে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে ডেনমার্ক। ১৯০টি দেশের মধ্যে ডেনমার্কে সবচেয়ে কম দুর্নীতি হয়। তার পর সবচেয়ে কম দুর্নীতি থাকা দেশগুলোর মধ্যে ৮৮ স্কোর নিয়ে ফিনল্যান্ড দ্বিতীয়, ৮৪ স্কোর নিয়ে সিঙ্গাপুর তৃতীয়, ৮৩ স্কোর নিয়ে নিউজিল্যান্ড চতুর্থ এবং ৮১ স্কোর নিয়ে যৌথভাবে লুক্সেমবার্গ, নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ড পঞ্চম স্থানে রয়েছে।
তবে ২০২৪ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির মাত্রা ছিল দক্ষিণ সুদানে। দেশটির স্কোর ১০০-এর মধ্যে মাত্র ৮। তার পর সর্বোচ্চ দুর্নীতির মাত্রা সোমালিয়া, ভেনেজুয়েলা, সিরিয়ায়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) প্রতিবেদন মতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম দুর্নীতি হয় ভুটানে। এর মধ্যে ৭২ স্কোর নিয়ে ওপরের দিক থেকে তাদের অবস্থান ১৮তম। দেশটিতে ২০২৩ সালের তুলনায়ও দুর্নীতি কমেছে। ভুটান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশেই গত বছর দুর্নীতি বেড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তান ১৭ পয়েন্ট নিয়ে সর্বনিম্ন স্কোর ও অবস্থানে রয়েছে। এ অঞ্চলে ৮টি দেশের মধ্যে আফগানিস্তানের পরই বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা সবচেয়ে বেশি।
প্রসঙ্গত, বিগত ২০১২ থেকে ২০২৪ সাল মেয়াদে সিপিআই স্কোরের প্রবণতা বিশ্লেষণ অনুযায়ী বাংলাদেশের এবারের স্কোর ১৩ বছরের গড় স্কোর ২৬ এর তুলনায় প্রায় তিন পয়েন্ট কম এবং এই মেয়াদে সর্বনিম্ন। এর মধ্যে টানা চার বছরসহ মোট ছয়বার বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২৬, তিনবার ২৫ এবং একবার করে ২৪, ২৭ ও ২৮। আর নিম্নক্রম অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো সর্বোচ্চ চারবার ১৩তম, তিনবার ১৪তম, দুইবার ১২তম এবং একবার করে ১৫, ১৬ ও ১৭তম।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন) মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
আরটিভি/কেএইচ