images

দেশজুড়ে

পলাতক থেকেও সরকারি জমি দখলের চেষ্টা আ.লীগ নেত্রীর

বুধবার, ২১ মে ২০২৫ , ০৬:৪৯ পিএম

images

ফরিদপুরের সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ঝর্না হাসানের নীলনকশায় সরকারি সম্পত্তি দখলের পাঁয়তারা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জমি ও বাড়ি দখলের জন্য ভারতীয় এক নাগরিককে এ দেশের নাগরিক সাজিয়ে জেলা প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে অর্পিত সম্পত্তিকে ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি হিসেবে দখলের চেষ্টা করছে এ কুচক্রী মহল।

সম্প্রতি এ ঘটনায় সম্পত্তি ভোগদখলকারী ফরিদপুর শহরের কোতোয়ালি থানাধীন দক্ষিণ আলীপুরের বাসিন্দা অচিন্ত কুমার চক্রবর্তী, দিলীপ কুমার চক্রবর্তী, জয় চক্রবর্তী, মিনতী রানী চক্রবর্তী ও বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী ফরিদপুরের সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। 

জানা যায়, মামলায় বিবাদী করা হয়েছে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার (ভূমি), ফরিদপুর পৌরসভার তহশিলদার ও বীরেশ চন্দ্র চক্রবর্তী নামের এক ব্যক্তিকে।

স্থানীয়রা জানান, দক্ষিণ আলীপুরের ২২ শতাংশ জমি অর্পিত সম্পত্তি হলেও সেটিকে ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি করার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই প্রভাবশালীরা চেষ্টা চালাচ্ছেন। ২০০০ সালে ফরিদপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকার সময় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হাসিবুল হাসান লাভলু ওই জমি ও বাড়ি দখলের চেষ্টা করেন। তিনি কাগজপত্র গায়েব করে দিয়ে নিজের নামে রেকর্ডও করিয়ে নেন। ২০০৮ সালে তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ঝর্না হাসান ওই জমির ওপর চোখ দেন।

গত বছর ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে ঝর্না হাসান পলাতক। কিন্তু পলাতক থেকেও কলকাঠি নেড়ে বর্তমান জেলা প্রশাসনকে ব্যবহার করে ওই জমি দখলের চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৫৪ বছর ধরে ওই জমির ওপর বাড়ি করে থাকা দুটি হিন্দু পরিবারকে উচ্ছেদের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।

ফরিদপুরের সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানাধীন আলীপুর মৌজার আরএস ৫৬৯ নম্বর খতিয়ানভুক্ত আরএস ৩১২৭ নম্বর দাগের ২২ শতাংশ জমির মালিক ছিলেন দীনেশ চন্দ্র সমাদ্দার।

তিনি স্বাধীনতার আগে সম্পত্তি রেখে ভারতে চলে যান। ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে স্থায়ীভাবে বসবাস করায় এবং আর কখনো এ দেশে ফিরে না আসার সুযোগে দীনেশ চন্দ্র সমাদ্দারের বাড়ির গৃহকর্মী ননীবালা দেবী এসএ রেকর্ডে তার নামে করে নেন জমিটি। পরবর্তী সময়ে ফরিদপুরের ডেপুটি কমিশনার ননীবালা দেবীকে নালিশি সম্পত্তি কিভাবে নিজ নামে এসএ রেকর্ড করালেন সে জন্য কারণ দর্শানোসহ দলিল-দস্তাবেজসহ তার কার্যালয়ে হাজির হতে নোটিশ দেন। ননীবালা ডেপুটি কমিশনের আদালতে হাজির হলেও এসএ রেকর্ড ননীবালার নামে করানোর পক্ষে কোনো কাগজপত্র বা উপযুক্ত দলিল-দস্তাবেজ হাজির করতে না পারায় ডেপুটি কমিশনার নালিশি সম্পত্তির বাবদে ননীবালা দেবীর নামীয় এসএ ৫৩২ নম্বর খতিয়ান কর্তন করে নালিশি জমিকে অর্পিত অনাগরিক সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করেন।

পরবর্তী সময়ে দেশ স্বাধীন হলে সরকার অর্পিত অনাগরিক সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করে অচিন্ত কুমার চক্রবর্তীর নামে ৫.২৫ শতাংশ এবং অন্যান্য বাদী ও তাদের আত্মীয়দের নামে বাকি সম্পত্তি সরকার লিজ প্রদান করে।

এর পর থেকে তারা খাজনা দিয়ে আসছেন। তারা ওই জমিতে বাড়িঘর তৈরি এবং বৃক্ষ রোপণ করেন। পরবর্তী সময়ে ননীবালা ওই সম্পত্তিকে অর্পিত সম্পত্তি নয় ও নিজের সম্পত্তি দাবি করে ফরিদপুরের প্রথম সাব জজ আদালতে দেঃ ৮৯/১৯৭৯ নম্বর মোকদ্দমা দায়ের করেন। দুই পক্ষের শুনানি শেষে আদালত মামলাটি ডিসমিস করে দেন। পরে ননীবালা দেবী এ রায়ের বিরুদ্ধে ফরিদপুরের জেলা জজ আদালতে আপিল মোকদ্দমা করলেও তিনি পরাজিত হন। পরবর্তী সময়ে ফরিদপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান হাসিবুল হাসান লাভলুর যোগসাজশে জরিপ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দিয়ে ভারতের নাগরিক বীরেশ চন্দ্র চক্রবর্তীর নামে এ দেশের ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে ননীবালা দেবীর মিথ্যা ওয়ারিশ সাজিয়ে ফরিদপুরে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে মামলা করে।

সহকারী কমিশনারকে (ভূমি)ক ভুল বুঝিয়ে এসএ রেকর্ডীয় মালিকের ভুয়া ওয়ারিশ দেখিয়ে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল আদালত থেকে ডিক্রি লাভ করে। ডিক্রি পেয়ে এ সম্পত্তি বিক্রি করে বীরেশ চন্দ্র চক্রবর্তী যাতে ভারতে পালিয়ে যেতে না পারে, সে জন্য গত ২০ মার্চ সহকারী কমিশনার ভূমিকে এই সম্পত্তি বীরেশের নামে নামপত্তন না করতে নিষেধমূলক নিষেধাজ্ঞা প্রদান ও তদন্ত করে কার্যক্রম গ্রহণের জন্য বাদীরা প্রস্তাব করেন। কিন্তু সহকারী কমিশনার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় বাদীরা আদালতে মামলা করতে বাধ্য হন।

বাদীদের একজন গণমাধ্যমকে বলেন, ওই জমির মালিক ছিলেন দিনেস চন্দ্র সমাদ্দার নামের একজন। তিনি স্বাধীনতার আগে ভারতে চলে যান। পরে তার সম্পত্তি দেখাশোনা করেন তার কাজের মহিলা ননীবালা। জমি রেকর্ড করার সময় ননীবালা তার নামে এসএ রেকর্ড করে ফেলেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৮ সালে এ জমিটি সরকার অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করে এবং বাদীদের কাছে লিজ দেয়। তিনি বলেন, সরকারের জমি অন্য কেউ দখল করে নেবে, সেটা মানব না। আমরা ৫৪ বছর ধরে সরকারি সম্পত্তি পাহারা দিচ্ছি।

এই জমির বিষয়টি নিয়ে ২০১৫ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনও তদন্ত করে। কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়, বর্ণিত জমিতে হাসিবুল হাসান লাভলু (বর্তমানে মৃত) সাবেক চেয়ারম্যান ফরিদপুর পৌরসভা, ননীবালা দেবী কর্তৃক আম মোক্তার নিযুক্ত হন ও উক্ত জমি দীর্ঘদিন তার ভোগদখলে ছিল এবং বর্তমানে তার ওয়ারিশদের ভোগদখলে রয়েছে। ভিপি/হাল জরিপে বর্ণিত জমি হাসিবুল হাসান লাভলুর নামে রেকর্ড করা হয়। বর্ণিত জমি বিজ্ঞ আদালতের রায়ে ‘ভেস্টেট প্রপার্টি’ মর্মে উল্লেখ করা হলেও উক্ত জমি কখনোই ভিপি সম্পত্তির তালিকাভুক্ত ছিল না এবং অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ (সংশোধন) আইন-২০১১ মোতাবেক প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের ‘ক’ ও ‘খ’ তফশিলভুক্ত সম্পত্তি হিসেবে প্রকাশিত হয়নি। উল্লিখিত জমির মূল মালিক ১৯৬৫ সালে দেশ ত্যাগ করার কারণে তা ‘ভেস্টেট প্রপার্টি’ বা ‘নন রেসিডেন্ট প্রপার্টি’ বলে গণ্য হবে। উল্লিখিত জমি হাসিবুল হাসান লাভলু (বর্তমানে মৃত)-এর পক্ষে বর্তমানে তার ওয়ারিশদের নামে যেভাবে জরিপে রেকর্ড হয়েছে তা অবৈধ মর্মে প্রতীয়মান হয়।

এক বাদীর অভিযোগ এসিল্যন্ড শফিকুল ইসলামের সঙ্গে ঝর্ণা হাসানের যোগসাজসে ভারতীয় নাগরিক বীরেশ চন্দ্রের নামে জমিটি নামজারির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তার অভিযোগ, মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে।

আরটিভি/এমকে-টি