বুধবার, ২৮ মে ২০২৫ , ১০:১৭ পিএম
এবার পবিত্র ঈদুল আজহায় কোরবানির জন্য চাঁদপুর জেলায় গবাদি পশু সংকটের আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্টরা। এ বছর জেলায় কোরবানির জন্য গবাদিপশুর চাহিদা রয়েছে ৭৬ হাজার ৩৫৪টি। আর গবাদি পশুর উৎপাদন হয়েছে ৬২ হাজার ৯৮টি। যা চাহিদার তুলনায় গবাদি পশুর সংকট রয়েছে ১৪ হাজার ২৫৬টি জানিয়েছেন জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়। গত বছর কোরবানি ঈদ উপলক্ষে জেলায় ২২৫টি পশুর হাট বসেছিল। এ বছরও সমপরিমাণ হাট বসারে। তবে প্রতিবছর কোরবানির সময় লক্ষ্য করা যায় যে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে গবাদি পশু আসে কোরবানির হাটে। এ বছরও যদি অন্যান্য জেলা থেকে গবাদি পশু আনা হয় তবে এ সংকট থাকবে না মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এদিকে কিছু সংখ্যক খামারি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, অনেক ভারতীয় গরু বাজারে দেখা যাচ্ছে। এ কারণে খামারিদের লোকসানের মুখে পড়তে হবে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলায় তালিকাভুক্ত খামারি রয়েছে ৩ হাজার ৭৭০ জন। খামারগুলোতে গরু উৎপাদন হয়েছে ৪২ হাজার ৪৯৭টি। ছাগল ভেড়া ও অন্যান্য পশু উৎপাদন হয়েছে ১৯ হাজার ৬০১টি। সব মিলিয়ে মোট উৎপাদন হয়েছে ৬২ হাজার ৯৮টি। কোরবানির জন্য গবাদি পশু প্রয়োজন ৭৬ হাজার ৩৫৪টি। এ হিসেব মতে জেলায় গবাদি পশু সংকট রয়েছে ১৪ হাজার ২৫৬টি। চলতি বছর জেলায় ষাঁড় গরু উৎপাদন হয়েছে ২৪ হাজার ২৪৭, বলদ ৭ হাজার ৭৮১, গাভি ১০ হাজার ৪৬৯টি। জেলায় সর্বমোট গরু উৎপাদন হয়েছে ৪২ হাজার ৪৯৭টি। মহিষ ২১৭টি, ছাগল ১৮ হাজার ৪৫৮, ভেড়া ৮৩০ ও অন্যান্য ৯৬টি।
চাঁদপুর সদর উপজেলায় গবাদি পশুর খামারি রয়েছে ৫ শত ১৪ জন। তাদের খামারে চলতি বছর মোট গবাদিপশু উৎপাদিত হয়েছে ১০ হাজার ৬ শত ৩৫টি। এর মধ্যে ষাঁড় ৪ হাজার ৮৩৬, বলদ ৩৯৯, গাভি ১ হাজার ৭৫৪, মহিষ ১৩০, ছাগল ৩ হাজার ৪১৬ এবং ভেড়া ১০০টি। এই উপজেলায় কোরবানির জন্য চাহিদা রয়েছে ১৪ হাজার ৬১৩টি গবাদি পশু। চাহিদার তুলনায় গবাদি পশুর ঘাটতি রয়েছে ৩ হাজার ৯৭৮টি।
কচুয়া উপজেলায় ৩ শত খামারে মোট গবাদিপশু উৎপাদন হয়েছে ৬ হাজার ৩৬২টি। এরমধ্যে ষাঁড় ২ হাজার ২২৮, বলদ ৭৩৯, গাভি ১ হাজার ৪ শত ৮, ছাগল ১ হাজার ৮৫৬ এবং ভেড়া ১৩১টি। এই উপজেলায় গবাদি পশুর চাহিদা রয়েছে ৬ হাজার ৯২২টি। গবাদি পশু ঘাটতি ৫৬০টি।
হাজীগঞ্জ উপজেলায় খামারি রয়েছে ৫০৫ জন। এসব খামারে মোট গবাদি পশু উৎপাদিত হয়েছে ১২ হাজার ৮ শত ৩৯টি। এরমধ্যে ষাঁড় ৪ হাজার ৪৪, বলদ ৪ শত ৫৫, গাভি ২ হাজার ৮ শত ৫৫, মহিষ ১০, ছাগল ৫ হাজার ৪ শত ৩০ এবং ভেড়া ৪৫টি। কোরবানির ঈদে গবাদি পশুর চাহিদা রয়েছে ১৩ হাজার। এখানে ১ শত ৬১টি গবাদি পশুর ঘাটতি রয়েছে ।
শাহরাস্তিতে খামারি রয়েছে ৫৩৩ জন। এসব খামারে মোট গবাদি পশু উৎপাদিত হয়েছে ৬ হাজার ১৮৩টি। এরমধ্যে ষাঁড় ২ হাজার ৫৭৬, বলদ ১ হাজার ১৩২, গাভি ১ হাজার ২৪১, মহিষ ৩৬, ছাগল ৯৫৮ এবং ভেড়া ২৪০টি। উপজেলায় গবাদি পশুর চাহিদা রয়েছে ১০ হাজার ৪ শত ৩৫টি। আর গবাদি পশুর ঘাটতি রয়েছে ৪ হাজার ২৫২টি।
মতলব দক্ষিণে খামারি রয়েছে ১৫৬ জন। এসব খামারে মোট গবাদি পশু উৎপাদিত হয়েছে ২ হাজার ৬৫১টি। এর মধ্যে ষাঁড় ৮৭৩, বলদ ২৪৭, গাভি ১৭০, ছাগল ১ হাজার ৩০১ এবং ভেড়া ৪৩টি। অন্যান্য পশু ১৭টি। তথ্য অনুসারে এই উপজেলায় আসন্ন কোরবানির ঈদে গবাদিপশুর চাহিদা ২ হাজার ৬৫১টি। তাই এখানে গবাদি পশু ঘাটতি নেই।
মতলব উত্তরে খামারি রয়েছে ৩৬৪ জন। এই উপজেলায় মোট গবাদি পশু উৎপাদিত হয়েছে ৪ হাজার ৮ শত ২টি। এরমধ্যে ষাঁড় ২ হাজার ৭০, বলদ ৯১০, গাভি ৬৯৪, মহিষ ৬, ছাগল ৯৩০ এবং ভেড়া ৭৫টি। অন্যান্য গবাদি পশু ৭৫টি। এই উপজেলায় গবাদি পশুর চাহিদা রয়েছে ৫ হাজার ২০০টি। এখানে ৩৯৮টি গবাদি পশুর ঘাটতি রয়েছে।
ফরিদগঞ্জ উপজেলায় খামারি রয়েছে ৬৮০ জন। এসব খামারে চলতি বছর গবাদিপশু উৎপাদিত হয়েছে মোট ১৫ হাজার ৯ শত ৫০টি। এর মধ্যে ষাঁড় ৬ হাজার ৫ শত ৭০, বলদ ৩ হাজার ৩৯৫, গাভি ১ হাজার ৮৬৫, ছাগল ৩ হাজার ৯৯৭, ভেড়া ১১৯টি। অন্যান্য ৪টি। এখানে গবাদি পশুর চাহিদা রয়েছে ২১ হাজার ২৩৩টি। গবাদি পশুর ঘাটতি রয়েছে ৫ হাজার ২৮৩টি।
হাইমচরে খামারি আছেন ২৫৩ জন। এসব খামারে চলতি বছর গবাদিপশু উৎপাদিত হয়েছে মোট ২ হাজার ৬৭৬টি। এরমধ্যে ষাঁড় ১ হাজার ৫০, বলদ ৫০৪, গাভি ৪৮২, মহিষ ৩৫, ছাগল ৫৭০ এবং ভেড়া ৩৫টি। এই উপজেলায় গবাদি পশুর চাহিদা রয়েছে ২ হাজার ৩০০টি। এই উপজেলায় গবাদি পশু উদ্বৃত্ত আছে ৩৭৬টি।
গবাদিপশুর ঘাটতির বিষয়ে চাঁদপুর সদর উপজেলার বালিয়া ইউনিয়নের খামারি আব্দুল মান্নান বলেন, যেসব খামারি দশটা গরু পালন করতেন তারা এখন তিন থেকে চারটা গরু পালন করেন। গরু পালন করার যে খরচ হয় বিক্রির সময় সে খরচ ওঠানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এতে অনেক খামারি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এ কারণেই উৎপাদন কম হয়েছে।
রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নের খামারি জসিম শেখ বলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে মানুষের সংসার খরচ চালাতে বাড়তি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যবসায় টাকা খরচ করা যাচ্ছে না। অনেকের কাছে জমানো টাকা ছিল না। ছিল গরু ছাগল। খরচ বেড়ে যাওয়ায় খামারিরা এগুলো বিক্রি করে সংসার খরচ জোগাড় করেছে। এতে গবাদিপশুর উৎপাদন কমে গেছে।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার খামারি জসিম উদ্দীন মিন্টু বলেন, গবাদি পশুর খাদ্যের দাম বৃদ্ধি, খড়ের অপর্যাপ্ততা এবং শ্রমিক সংকটের কারণে অনেকের ইচ্ছে থাকলেও গবাদিপশু পালনে আগ্রহ হারাচ্ছে।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার আরেক খামারি মোহাম্মদ শাহাবুদ্দীন বলেন, আমি গত কয়েক বছর ধরে গরুর খামার করে আসছি। আমার খামারে গরুর পাশাপাশি ছাগলও আছে। পশু খাদ্যের দাম হাতের নাগালে থাকলে আমাদের পশু পালন করে পোষাতো। কিন্তু এখন তেমন লাভ হয় না। তারপরও খামারের পিছনে অনেক টাকা লগ্নি করেছি বলেই চালিয়ে যাচ্ছি। গতবছর বন্যার ফলে খড়ের দাম অনেক বেড়েছে। তখন নিয়মিত খড় জোগাড় করতেও আমাদের হিমশিম খেতে হয়েছে।
চাঁদপুর সদর উপজেলার সফরমালী কোরবানি পশুর হাটে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় ৭ হাজার পশু হাটে উঠেছে। ক্রেতাদের উপস্থিতিও ছিল পর্যাপ্ত। কোরবানির জন্য মানুষের পছন্দ দেশি গরু। খামারিরা ভালো দাম পেয়েছে বাজারে। তবে বাজারে ভারতীয় গরুর দেখা মিলেছে ব্যাপক হারে। দামও অনেক বেশি। দেশি গরু বেচাকেনা করে ক্রেতা বিক্রেতারও বেশ খুশি।
চাঁদপুর জেলার কয়েকটি উপজেলা গরু পালনের জন্য প্রসিদ্ধ। এগুলো হলো সদর উপজেলা, ফরিদগঞ্জ উপজেলা এবং মতলব উত্তর উপজেলা। সদর উপজেলাতে চরাঞ্চল থাকায় মানুষ সহজে গরু পালন করতে পারে। চরাঞ্চলে অনেক জমি আছে। এখানে প্রাকৃতিকভাবে ঘাস জন্মায়। তাই এখানে গরু পালনে খরচ কম হয়। অন্যান্য খাবার কম প্রয়োজন পড়ে। আর ফরিদগঞ্জ ও মতলব উত্তর উপজেলায় জেলার সর্বোচ্চ ধান আবাদ হয়। গরুর প্রধান খাদ্য খড়ের উৎপাদনও বেশি। এখানেও গরু পালনে বাড়তি খরচ বহন করতে হয় না খামারিদের।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. জ্যোতির্ময় ভৌমিক জানান, গত বছর কোরবানির জন্য যে পরিমাণে পশুর চাহিদা ছিল, এ বছর চাহিদা তার চেয়ে বেশি হিসেব করা হয়েছে। এ বছর গরুর দাম বেশি হবে বলেও তিনি জানান। জেলায় সামান্য কিছু পশু সংকট রয়েছে। আমরা আশা করি ঈদে এ সংকট থাকবে না। প্রতি ঈদে আমাদের এখানে কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে গরু নিয়ে আসে হাটে তোলার জন্য। এ বছরও এভাবে হাটে গরু আসবে। তাই কাগজে-কলমে যেটুকু সংকট দেখা যাচ্ছে ঈদে তা থাকবে না।
আরটিভি/এএএ/এস