বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫ , ০৩:৩৭ পিএম
ভোলা থেকে ঢাকাগামী যাত্রীবাহী লঞ্চ কর্ণফুলী-৪ থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে নিখোঁজ হওয়ার ৪ দিন পর ভোলা সরকারি কলেজ ছাত্রদল নেত্রী সুকর্ণা আক্তার ইপ্সিতার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ছাত্রদল ইপ্সিতা মৃত্যুর প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন ও শাস্তির দাবি জানিয়েছে।
সম্প্রতি এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ইপ্সিতা মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করে দোষীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানিয়েছে ছাত্রদল।
দলের দপ্তর সম্পাদক (সহসভাপতি পদমর্যাদা) মো. জাহাঙ্গীর আলম স্বাক্ষরিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ভোলা সরকারি কলেজ ছাত্রদল নেত্রী সুকর্ণা আক্তার ইপ্সিতার মরদেহ ৪ দিন পর লক্ষ্মীপুরসংলগ্ন মেঘনা নদী থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। ১৭ জুন লঞ্চযোগে ঢাকায় যাওয়ার পথে ইপ্সিতা লঞ্চের তৃতীয় তলা থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন। অভিযোগ আছে, ইপ্সিতা লঞ্চে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ইতোপূর্বে জুলাইযোদ্ধা ইপ্সিতাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পতিত ফ্যাসিস্টের পদলেহীরা সরাসরি হুমকি প্রদান করেছে।
ইপ্সিতার মৃত্যুর পরেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের উল্লাস লক্ষণীয়। সে ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এই হত্যাকাণ্ডের অন্তরালের প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন ও খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির ছাত্রদল নেত্রী ইপ্সিতার আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন।
একই সঙ্গে তারা অবিলম্বে এই হত্যাকাণ্ডের যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনার উন্মোচন ও হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে।
নিহত ইপ্সিতার পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ১৭ জুন সকালের দিকে বাসা থেকে প্রাইভেট পড়ানোর কথা বলে বের হন তিনি। পরে আর বাসায় ফেরেননি। পরদিন ইপ্সিতার বাবা ভোলা সদর মডেল থানায় নিখোঁজ দাবি করে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।
এ দিকে ফেসবুকে অনেকে অভিযোগ করছেন, এক ছাত্রদল নেতা ইপ্সিতার মৃত্যুর জন্য দায়ী। ইপ্সিতা ভোলা সরকারি কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। তিনি কোনো পদে না থাকলেও কলেজ ছাত্রদলের রাজনীতি করতেন। তার মৃত্যু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা রকমের বাজে মন্তব্য করা হচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে কলেজ শাখা ছাত্রদল।
মঙ্গলবার কলেজের সামনে মানববন্ধন করে সংগঠনের পক্ষ থেকে মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন এবং অপরাধীর শাস্তি দাবি করেন।
এ বিষয়ে কর্ণফুলী লঞ্চ কোম্পানির ম্যানেজার আলাউদ্দিন বলেন, ১৭ জুন সকালে কর্ণফুলী-৪ লঞ্চ থেকে মেহেন্দীগঞ্জের পরে ইলিশা থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে লঞ্চের তৃতীয় তলা থেকে এক তরুণী নদীতে ঝাঁপ দেন। লঞ্চের মাস্টার খবর পেয়ে এক ঘণ্টাব্যাপী তাকে উদ্ধারের জন্য লঞ্চ ব্যাক গিয়ার দিয়ে খোঁজাখুঁজি করেন। তাকে না পেয়ে পরে লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশে চলে যায়। এ ঘটনায় লঞ্চে থাকা অন্য আরেক নারী ৯৯৯-এ কল দিয়ে ঝাঁপ দেওয়া তরুণী ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে অভিযোগ দেন। পরে মুন্সিগঞ্জ সদর থানার পুলিশ ওই লঞ্চ থেকে দুজন স্টাফ ও অভিযোগকারীকে হেফাজতে নেয়। ঘটনার প্রাথমিক তথ্য জেনে পরে পুলিশ তাদের ছেড়ে দেয়।
ওই লঞ্চের সুপারভাইজার নান্টু দে বলেন, ভোলার ইলিশা ঘাট থেকে সকাল সোয়া ১০টার দিকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে কর্ণফুলী-৪। কালীগঞ্জ ঘাট পার হওয়ার কিছু সময় পর তিনি খবর পান, এক নারী তৃতীয় তলা থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে লঞ্চটি ঘুরিয়ে ঘটনাস্থলের কাছাকাছি গিয়ে লাইফবয়া ফেলা হয়। একবার ওই তরুণীকে নদীতে ভাসতে দেখা গেলেও কাছে পৌঁছানোর আগেই তিনি চোখের আড়াল হয়ে যান। পরে ঘণ্টাখানেক খোঁজাখুঁজির পর কোস্টগার্ডকে জানিয়ে লঞ্চটি ঢাকার পথে রওনা দেয়। পরে কোস্টগার্ড দক্ষিণ জোনের সদস্যরা ওই নারীকে উদ্ধারের জন্য অভিযান চালান। কিন্তু নিখোঁজ তরুণীকে ওই দিন আর উদ্ধার করা যায়নি।
লঞ্চের কর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ইলিশা ঘাট থেকে লঞ্চে ওঠার সময় ওই তরুণী কেবিন নেন। তবে কেবিন ভাড়ার টাকা না থাকায় কেবিনম্যান তাকে ওপরের তলায় অবস্থান করতে বলেন। পরে তাকে তৃতীয় তলায় মোবাইলে কারও সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। কথোপকথনের একপর্যায়ে তিনি অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকেন এবং হঠাৎ করেই নদীতে ঝাঁপ দেন। তাৎক্ষণিক যাত্রীরা চিৎকার শুরু করলে লঞ্চ থামিয়ে উদ্ধার অভিযান চালানো হয়। তবে পানিতে ডুবে যাওয়ায় তাকে আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
মেয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে চোখ মুছে নিহত ইপ্সিতার মা বলেন, ১৭ জুন মঙ্গলবার সকাল আটটায় মেয়ে প্রাইভেট পড়াতে যায়। ওই দিন বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার কথা ছিল, দেখা করে সাড়ে ১১টার দিকে ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু সময়মতো না আসায় ১২টার দিকে ফোন দেন। তখন ফোন বাজলেও ধরেনি। এভাবে পরের দিন বুধবার ৩টা পর্যন্ত কল করতে থাকেন। কিন্তু কেউ ধরেনি। ৪টার পরে আর রিং বাজেনি। তার পর থেকে মেয়ের স্কুল, কলেজ, প্রাইভেট বাসায়, বান্ধবীদের বাসায় খোঁজ করেছেন। কোথাও পাননি। চার দিন পরে জানতে পারেন, লঞ্চ থেকে একটি মেয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে। তখন লঞ্চেও খোঁজ করে জানতে পারেন, ওই মেয়ে তারই মেয়ে।
ফেসবুকের নানা আলোচনার প্রসঙ্গে ওই ছাত্রীর মা বলেন, ও আমাকে কোনো দিন বলেনি, কোনো ছেলে ওকে ডিস্ট্রাব করেছে। ও নীরবে স্কুল-কলেজে যেত, আবার নীরবে ফিরে আসত। ওকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী ও বান্ধবীদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলতে শুনেছি। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে থ্রেট দেয় বলে অভিযোগ করতে দেখিনি।
ইপ্সিতার বাবা একজন অটোরিকশাচালক উল্লেখ করে মা আরও বলেন, ওর বাবা খাইয়া না খাইয়া ওকে পড়ালেখা করাইছে। ছেলেমেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করার আশায়। তিন সন্তানকে (দুই মেয়ে, এক ছেলে) মানুষের মতো মানুষ করতে চেষ্টা করছে। যাতে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়িয়ে মানুষের মতো মানুষ হয়ে বাঁচতে পারে। এটাই আমাদের আশা ছিল।
ঘটনার বিষয়ে মুন্সিগঞ্জ থানার ওসি এম সাইফুল আলম বলেন, ১৭ জুন কর্ণফুলী-৪ লঞ্চ থেকে এক নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে ৯৯৯-এ অভিযোগ আসে। পরে পুলিশ ওই লঞ্চের দুই স্টাফ ও অভিযোগকারীকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসে। ঘটনার তথ্যাদি সংগ্রহ করে তাদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় ছেড়ে দেওয়া হয়।
লক্ষ্মীপুর মডেল থানার ওসি (তদন্ত) ঝলক মোহন্ত বলেন, এ ঘটনায় লক্ষ্মীপুর নৌপুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে বলে জেনেছি।
আরটিভি/এমকে