শুক্রবার, ১২ জুলাই ২০২৪ , ০৬:৪১ পিএম
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির অবস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যবর্তী একটি স্থানে। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ভবন ৫ তলা। এর মধ্যে প্রথম দুতলায় প্রায় ৪০ হাজারের বইভাণ্ডারসহ পত্রপত্রিকা রয়েছে। তৃতীয় তলাটি শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত বই নিয়ে পড়ার জন্য রাখা হয়েছে। ৪র্থ ও ৫ম তলা বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দপ্তর ও শিক্ষার্থীদের কয়েকটি সংগঠনের অফিস হিসেবে। বর্তমানে প্রথম ৩ তলা বা ক্ষেত্রবিশেষে প্রথম ২ তলাকে লাইব্রেরি হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলে থাকেন। প্রথম দুতলায় আসন সংখ্যা ১৫০ এর কম-বেশি। ৩য় তলায় ব্যক্তিগত বই নিয়ে পড়ার জায়গায় কিছু চেয়ার টেবিল রয়েছে। কিন্তু এই হিসেবের বিপরীতে পাঠকদের উপস্থিতি সন্তোষজনক নয় বলে মনে করেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এটি কেবল বর্তমান সময়ের চিত্র নয় বরং দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ব্যবহারে অনীহার চিত্র বলে মূল্যায়ন করছেন তারা।
শিক্ষার্থীদের থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, দীর্ঘ সময় ধরে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে তারা গড়ে ১৫ থেকে ২০ জন শিক্ষার্থী দেখেছেন। এরমধ্যে কিছু নিয়মিত শিক্ষার্থী রয়েছেন, কিছু অনিয়মিত শিক্ষার্থী রয়েছেন। পরীক্ষার আগে আগে শিক্ষার্থী আসার সংখ্যা কিছুটা বাড়ে। চাকরির প্রস্তুতি নিতে শিক্ষার্থীদের কয়েকটি ছোট গ্রুপ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোসহ আশেপাশে ২ থেকে ৩ হাজার শিক্ষার্থী বসবাস করেন। হল ও বিভিন্ন বিভাগে রিডিং রুম ও সেমিনার লাইব্রেরি রয়েছে। শিক্ষার্থীরা সেখানেও পড়েন।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় সঙ্গীত বিভাগের অধ্যাপক ড. জাহিদুল কবীরের সঙ্গে। তিনি আরটিভি নিউজকে বলেন, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি সন্তোষজনক নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি, একাডেমিক যে পড়াশোনা সেদিক দিয়ে গ্রন্থাগার ব্যবহারে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ একেবারেই কম। দেখা যায়, চাকরির পরীক্ষা বা এই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তারা ব্যস্ত।
কেন আগ্রহ কম প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটা বলতে গেলে কিছুটা আমাদের দিকেও আসে। সৃষ্টিশীল শিক্ষাচর্চা যেখানে থাকে সেখানে লাইব্রেরি ব্যবহার বেশি থাকে।
সৃষ্টিশীল লেখাপড়া নিয়ে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা মনে করে পূর্বসূরিদের থেকে প্রাপ্ত যে মুখস্ত করা নোট, গাইড বা এ জাতীয় তাদের পড়লে বোধহয় হয়ে যাবে। বা সুনির্দিষ্ট কিছু বই আছে সেগুলো পরীক্ষার আগের দিন পড়েই তারা পরীক্ষা দেয়। এই পরীক্ষা ব্যবস্থা যদি সৃষ্টিশীল হতো তাহলে তাকে অনেকগুলো বই পড়তে হতো। সেটা হয়না বিধায় লাইব্রেরিতে তারা অতটা যায় না।
অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী আনারুল বলেন, ‘লাইব্রেরিতে না আসার মূল কারণ হলো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। আমাদের দেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক এমনকি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে মুক্তজ্ঞান চর্চা শিক্ষকরাই করেননা। ফলে শিক্ষার্থীরা কখনও মুক্তজ্ঞান চর্চার কথা শুনেনা, অনুপ্রাণিত হয়না। শুধু তাই নয়, এর জন্য যে একটা পাঠাগার প্রয়োজন সেই পাঠাগারটাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নাই। মুক্তজ্ঞান চর্চা করা একটা নেশা। এই নেশা একদিনে তৈরি হয়না। এই শিক্ষার্থীরাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসে। এবং বই পড়ার নেশা, মুক্তজ্ঞান চর্চার আকাঙ্ক্ষা এবং আলোর জগতে প্রবেশের যে ইচ্ছা শক্তি সেটি না থাকার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে এই সুযোগ পেলেও সে সুযোগটা নিতে পারেনা। বই পড়ার আকাঙ্ক্ষা, জানার ইচ্ছা, আলোর জগতে প্রবেশ এবং মুক্তজ্ঞান চর্চায় অভ্যস্ততা না থাকার ফলে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে এই সুবিধা পেলেও নিতে পারেনা। যার ফলে আমাদের পাঠাগারগুলো খালি থাকে। শিক্ষার্থীরা পাঠাগারে আসেনা।’
লাইব্রেরি একেবারে ব্যবহার করেন না এমন একজন শিক্ষার্থীর নাম মোস্তফা। তিনি বলেন, ‘আমি বিভিন্ন ধরনের বই পড়লেও লাইব্রেরিতে যাওয়া হয় না। এর কারণ আমার পড়ার ধরন। বিছানায় শুয়ে পড়তে আমার কম্পোর্ট লাগে।’
শিক্ষার্থীরা বলছেন, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সুযোগ সুবিধা আরও বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থীদেরকেও বইমুখী হতে হবে।
কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির জুনিয়র লাইব্রেরিয়ান মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘টাইম-টু-টাইম উপস্থিতি নির্ভর করে এখানে। যেমন পরীক্ষা কেন্দ্রীক একটা উপস্থিতি দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। অনেক সময় দেখা যায় লাইব্রেরি পূরণ হয়, অনেক সময় ফাঁকা থাকে। চলতি বছর থেকে উপস্থিতির একটা এন্ট্রি রাখা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।’
কয়েক বছর আগেও কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে বইয়ের স্বল্পতা আছে বলে জানাতেন বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি তাদের থেকে মুক্ত চাহিদা আহ্বান করে বই সংযোজিত করা রয়েছে। শুধু বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের চাহিদা নয়, শিক্ষক সমিতিসহ ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজ ও পরিবেশবাদী একটি সংগঠনের চাহিদা নিয়ে প্রায় ৩ হাজার বই আনা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘গ্রন্থাগার যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটিকে আপডেটেড রাখতে হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রত্যেক মাসে ২ জন, ৩ জন বা ৫ জনকে লাইব্রেরির সর্বোচ্চ ব্যবহারকারী হিসেবে শিক্ষার্থীকে প্রণোদনামূলক ন্যূনতম একটি সনদ বা একটি পত্র দেওয়া যেতে পারে। এভাবেই শিক্ষার্থীদের আমরা গ্রন্থাগারমুখী করার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করতে পারি।’
এ বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর আরটিভি নিউজকে বলেন, ‘বিভাগীয় সেমিনার লাইব্রেরি ও হলে পাঠকক্ষ থাকায় লাইব্রেরিতে উপস্থিতি কম। লাইব্রেরিতে যাওয়ার সংস্কৃতি উন্নত করতে বিভিন্ন সংগঠন কাজ করতে পারে। আমরাও কর্মসূচি গ্রহণের কথা ভাবছি।’