সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫ , ০৫:৪৯ পিএম
চারদিন ধরে ভয়াবহ সংঘাত চলছে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে। যুদ্ধবিরতি আলোচনা শুরুর প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর ক্রমেই আরও ভয়ংকর হয়ে উঠছে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি। এ সংঘাতে ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলকে আড়াল থেকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এখন পর্যন্ত সংঘাতে জড়িত থাকার কথা স্বীকার না করলেও ভবিষ্যত পরিস্থিতি বিবেচনায় সংঘাতে জড়ানোর ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার কথা অনুযায়ী, ক্ষমতাধর যুক্তরাষ্ট্র যদি প্রকাশ্যে এ সংঘাতে সত্যিই জড়িয়ে যায়, তাদের অবস্থান যে মিত্র ইসরায়েলের বিপক্ষে হবে না, এটা সহজেই অনুমেয়।
এ অবস্থায় ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র, বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার অবস্থান তখন কেমন হবে, সেটা নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। তারাও যুক্তরাষ্ট্রের মতো নিজেদের মিত্রের পক্ষ নিয়ে সংঘাতে জড়াবে কি না কিংবা কতটুকু জড়াবে, বিশ্ববাসীর কৌতূহলের বিষয় সেটাও।
অবশ্য এখন পর্যন্ত ইরানের সমর্থন করতে দেখা যাচ্ছে চীন ও রাশিয়াকে, যদিও এক্ষেত্রে চীনের অবস্থানের ধরন কিছুটা মধ্যপন্থী। গত শুক্রবার (১৩ জুন) জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে ইসরায়েলের অব্যাহত হামলার নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে উত্তেজনা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে দুদেশ। চলমান এ সংঘাতের ফলে ভয়াবহ বৈশ্বিক পরিণতি হতে পারে বলেও সতর্ক করেছে তারা।
সবশেষ সোমবার (১৬ জুন) এক বিবৃতিতে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গুও জিয়াকুন বলেন, আমরা সব পক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছি যেন তারা অবিলম্বে এমন পদক্ষেপ নেয় যা উত্তেজনা কমাবে এবং মধ্যপ্রাচ্যকে আরও বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেওয়া থেকে রক্ষা করবে। সেইসাথে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে যাওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করবে।
গতকাল চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরেক মুখপাত্র বলেছিলেন, চলমান উত্তেজনা কমানোর প্রক্রিয়ায় গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে আগ্রহী চীন।
এর আগে গত ১৩ জুন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের সাপ্তাহিক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, ইরানের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও ভূখণ্ডের অখণ্ডতা লঙ্ঘনের বিরোধিতা করে তারা। যারা আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়ায় বা সংঘাত সৃষ্টি করে, তাদের যেকোনো কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে চীন।
চীনের এক মুখপাত্রকে ওই সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়—যদি আবার ইরানের ওপর হামলা হয়, তবে হরমুজ প্রণালী বন্ধের ইরানি হুমকিকে কি চীন সমর্থন করবে?
তিনি সরাসরি জবাব দেননি, বরং বলেছেন—এ ধরনের অনুমানভিত্তিক প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ঠিক নয় এবং এই অঞ্চলের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে, সেটা কেউই চায় না।
২০২৪ সালের অক্টোবর মাসেও একই রকম অবস্থান নিয়েছিল চীন। তখনকার চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজকে বলেছিলেন, অব্যাহত যুদ্ধ ও বিশৃঙ্খলা এ অঞ্চলের কোনো পক্ষের জন্যই ভালো নয়।
ওই একই মাসে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচির সঙ্গে বৈঠকে ওয়াং ই বলেন, চীন যেকোনো উত্তেজনা ও সংঘাতের বিরুদ্ধে এবং কোনো সামরিক কর্মকাণ্ড সমর্থন করে না। শান্তির পক্ষে থেকে গঠনমূলক ভূমিকা রাখবে চীন।
এছাড়াও, ২০২৪ সালের অক্টোবরেই জাতিসংঘে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের কড়া সমালোচনা করেন চীনের প্রতিনিধি ফু কং। তিনি ইরানে ইসরায়েলের হামলা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং ইসরায়েলকে সব ধরনের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করার আহ্বান জানান।
সবশেষে, ২০২৫ সালের ১২ জুন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA)-এর বোর্ড অব গভর্নরস-এর এক ভোটাভুটিতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জার্মানির আনা একটি প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয় চীন ও রাশিয়া। ওই প্রস্তাবে ইরানের ওপর পারমাণবিক প্রতিশ্রুতি ভাঙার অভিযোগ আনা হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে যাওয়াকে আজকের সমস্যার মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করে চীনের প্রতিনিধি লি সং বলেন, আন্তর্জাতিক সমাজ যেন অবরোধ, চাপ ও শক্তির হুমকি ব্যবহার না করে।
এদিকে ইরানে ইসরায়েলের হামলা নিয়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনগুলো খুব বেশি প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত দুটি প্রধান চ্যানেল-রাশিয়া চ্যানেল ১ এবং চ্যানেল ওয়ান রিপোর্ট করেছে যে ইসরায়েল শুধু পারমাণবিক স্থাপনাগুলো নয়, বেসামরিক এলাকাও লক্ষ্যবস্তু করেছে।
রাশিয়া চ্যানেল ১ জানিয়েছে যে, এই প্রথমবারের মতো আবাসিক এলাকায় হামলা চালানো হয়েছে। অবশ্য দুটি চ্যানেলই জোর দিয়ে বলেছে, এসব এলাকায় ইরানের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারা অবস্থান করায় এগুলো টার্গেট করা হয়। তবে এতে বেসামরিক লোকজনও নিহত হয়েছে।
টেলিগ্রামে ‘জাপিসকি ভেটেরান’ নামের একটি চ্যানেল ধ্বংস হওয়া ভবন ও গাড়ির ছবি প্রকাশ করে ব্যঙ্গ করে লিখেছে, এইসবই সম্ভবত সেই পারমাণবিক সামরিক স্থাপনা, যার কথা ইসরায়েল বলছিল। এখন দেখা যাক, তথাকথিত সভ্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আজ কী প্রতিক্রিয়া দেখায়।
সার্গেই মার্কভ নামে একজন প্রো-ক্রেমলিন ভাষ্যকার ও রাশিয়ার সাবেক সংসদ সদস্য বলেন, রাশিয়া সম্প্রতি ইরানের সঙ্গে একটি বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তিতে সই করেছে, তবে রাশিয়া এই সংঘাতে জড়াবে বলে মনে হচ্ছে না।
মার্কভ তার টেলিগ্রাম চ্যানেলে লেখেন, রাশিয়া ইরানের বন্ধু এবং রাজনৈতিক মিত্র, কিন্তু সামরিক মিত্র নয়। রাশিয়ার একমাত্র সম্ভাব্য ভূমিকা হতে পারে একটি রাজনৈতিক সমাধানে মধ্যস্থতা করা। তবে সেটা পরে হবে। এখন রাশিয়া ও অন্য সব দেশ সামরিক-মিসাইল পর্যায় পর্যবেক্ষণ করবে।
রাশিয়ার চ্যানেল ওয়ানের উপস্থাপক আরতিয়ম শেইনিনও টেলিগ্রামে একমত পোষণ করে বলেন, সবকিছুই খুব অনিশ্চিত। সম্প্রতি ইউক্রেন থেকে মধ্যপ্রাচ্যে হাজার হাজার বিমান প্রতিরক্ষা শেল সরিয়ে নেওয়ার খবর ইঙ্গিত দেয় যে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো দ্বিমুখী খেলা খেলছে।
আরটিভি/এসএইচএম