শনিবার, ২১ জুন ২০২৫ , ০৪:৪৫ পিএম
২০২৫ সালের ১৩ জুন, বিশ্ব আরেকবার একতরফা সামরিক আগ্রাসনের বিপজ্জনক পরিণতির সাক্ষী হয়েছে, যখন ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে গভীরভাবে উদ্বেগজনক ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারী হামলা চালিয়েছে, যা দেশটির সার্বভৌমত্বের ওপর সরাসরি আঘাত।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এই বোমা হামলা এবং ইরানি ভূখণ্ডে লক্ষ্যবস্তু করে চালানো হত্যাকাণ্ডের কঠোর নিন্দা জানায়। এই ঘটনাগুলো একটি বিপজ্জনক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে, যার গুরুতর আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক প্রভাব পড়তে পারে। গাজার প্রতি ইসরায়েলের নৃশংস আক্রমণের মতোই এই অভিযানও বেসামরিক মানুষের জীবনের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীনতা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতি অবজ্ঞার পরিচায়ক। এসব কর্মসূচি কেবল অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করবে এবং আরও সংঘাতের বীজ বপন করবে।
এ হামলা এমন এক সময়ে হয়েছে, যখন ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ইতিবাচক ইঙ্গিত দিচ্ছিল। এ বছর ইতোমধ্যে পাঁচ দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে, এবং জুন মাসেই ষষ্ঠ দফা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। এমনকি ২০২৫ সালের মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ড মার্কিন কংগ্রেসে স্পষ্টভাবে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না এবং দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনেই ২০০৩ সালে স্থগিত হওয়ার পর থেকে পারমাণবিক কর্মসূচি পুনরায় চালুর অনুমতি দেননি।
নেতানিয়াহুর শাসনে ইসরায়েল
বর্তমান ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্ব দীর্ঘদিন ধরেই শান্তি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং চরমপন্থাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। তার সরকারের অধীনে অবৈধ বসতি সম্প্রসারণ, উগ্র জাতীয়তাবাদী দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠন, এবং দ্বিরাষ্ট্র সমাধানে বাধাদানের কারণে শুধু ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্ভোগই বেড়েছে না, গোটা অঞ্চলটিই এক প্রকার স্থায়ী সংঘাতের দিকে ধাবিত হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৯৯৫ সালে প্রধানমন্ত্রী ইৎজাক রবিনের হত্যার পেছনে ঘৃণা উসকে দিতে নেতানিয়াহু যে ভূমিকা রেখেছিলেন, তা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়ার অন্যতম আশাব্যঞ্জক উদ্যোগের পরিসমাপ্তি ঘটায়।
ইরান নিয়ে নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা কী?
এই পটভূমিতে নেতানিয়াহুর পক্ষ থেকে সংঘাতের পথ বেছে নেওয়া অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি একসময় অনন্ত যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন, এখন সেই ধ্বংসাত্মক পথেই হাঁটছেন। তিনিই একসময় বলেছিলেন, কিভাবে ভুয়া অভিযোগে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং কীভাবে তা গোটা অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল। তাই ১৭ জুন, ট্রাম্পের নিজের গোয়েন্দা প্রধানের মূল্যায়ন অস্বীকার করে যখন তিনি বলেন, ‘ইরান খুব কাছেই পৌঁছে গেছে’ পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পথে—তা অত্যন্ত হতাশাজনক। বিশ্ব আশা করে নেতৃত্ব এমন হবে যা সত্য নির্ভর এবং কূটনৈতিক, বলপ্রয়োগ ও মিথ্যার ওপর নয়।
দ্বৈত মানদণ্ডের কোনো স্থান নেই
এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, একটি পারমাণবিক ইরান নিয়ে ইসরায়েলের উদ্বেগ অমূলক নয়। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, দ্বৈত মানদণ্ড গ্রহণযোগ্য। ইসরায়েল নিজেই পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্র এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর বিরুদ্ধে একাধিকবার সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে। এর বিপরীতে, ইরান এখনো পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ সংক্রান্ত চুক্তি (NPT)-এর সদস্য এবং ২০১৫ সালের যৌথ চুক্তি অনুযায়ী তারা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে কড়া সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েছিল। সেই চুক্তি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে চলছিল, যতক্ষণ না ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে তা বাতিল করে। এই সিদ্ধান্ত দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক প্রক্রিয়াকে ভেঙে দেয় এবং আবারও গোটা অঞ্চলকে অনিশ্চয়তার মুখে ফেলে।
ভারতও এই পরিস্থিতির ভুক্তভোগী। ইরানের ওপর পুনঃনিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে চাবাহার বন্দর ও আন্তর্জাতিক উত্তর-দক্ষিণ পরিবহন করিডোরসহ আমাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে—যেগুলো মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ বাড়ানোর এবং আফগানিস্তানে সরাসরি প্রবেশের সুযোগ এনে দিচ্ছিল।
ইরান ভারতের দীর্ঘদিনের বন্ধু, এবং আমাদের মাঝে গভীর সভ্যতাগত সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৯৪ সালে কাশ্মীর ইস্যুতে জাতিসংঘে ভারতের বিরুদ্ধে প্রস্তাব ঠেকাতে ইরান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান, পূর্বতন রাজতান্ত্রিক ইরানের চেয়ে অনেক বেশি ভারত-সমর্থক অবস্থানে থেকেছে, যে রাজতন্ত্র ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে ছিল।
ভারতের দায়িত্ব
সম্প্রতি ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এই অনন্য অবস্থান আমাদের একটি নৈতিক দায়িত্ব ও কূটনৈতিক প্রভাব দিয়েছে—উত্তেজনা প্রশমন ও শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য কার্যকর সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে। এটি কেবল নীতিগত প্রশ্ন নয়। পশ্চিম এশিয়ায় লক্ষাধিক ভারতীয় নাগরিক কাজ করছেন। ফলে এ অঞ্চলের শান্তি আমাদের জাতীয় স্বার্থের বিষয়। ইসরায়েলের এই সাম্প্রতিক হামলা এমন এক প্রেক্ষাপটে হয়েছে যেখানে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রায় নিঃশর্ত সমর্থনে ইসরায়েল কার্যত দায়মুক্ত। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস অকপটে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ভয়ঙ্কর ও অগ্রহণযোগ্য হামলার নিন্দা করেছিল। কিন্তু আমরা ইসরায়েলের পক্ষ থেকে পরিচালিত বিপর্যয়কর ও অপ্রতিরোধ্য প্রতিক্রিয়ার মুখে নীরব থাকতে পারি না। ইতোমধ্যে ৫৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। পুরো পরিবার, মহল্লা, এমনকি হাসপাতাল পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজা দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে এবং সেখানকার বেসামরিক জনগণ অসহনীয় কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
ভারতের নীরবতা: একটি বিপজ্জনক সরে আসা
এই মানবিক বিপর্যয়ের মুখে নরেন্দ্র মোদি সরকারের নীরবতা ভারতের দীর্ঘদিনের নীতিনিষ্ঠ ও ন্যায়ভিত্তিক কূটনীতির পথ থেকে একটি বিপজ্জনক বিচ্যুতি। এটি কেবল আমাদের কণ্ঠের হারানো নয়, এটি আমাদের মূল্যবোধেরও পরাজয়। তবে এখনও দেরি হয়ে যায়নি। ভারতকে স্পষ্টভাবে কথা বলতে হবে, দায়িত্বশীলভাবে কাজ করতে হবে এবং সমস্ত কূটনৈতিক চ্যানেল ব্যবহার করে উত্তেজনা কমানো ও পশ্চিম এশিয়ায় আলোচনার পথে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
সূত্র: ‘দ্য হিন্দু’ থেকে অনুবাদ করা
আরটিভি নিউজ-টি