বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫ , ০৪:৩৯ পিএম
তালাক শব্দের অর্থ বিবাহ বিচ্ছেদ। প্রতিটি ব্যক্তির বিবাহ-তালাক তার ধর্মীয় আইন অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মুসলিম আইন অনুযায়ী একজন পুরুষ শর্তহীনভাবে তার স্ত্রীকে তালাক প্রদান করতে পারেন, তবে একজন মুসলিম স্ত্রীর তালাক প্রদানের ক্ষমতা শর্তহীন নয়।
স্ত্রীর তালাক প্রদানের ক্ষমতা
একজন মুসলিম স্ত্রী কর্তৃক তালাক প্রদানের সুযোগ খুব সংকুচিত এবং সাধারণভাবে শর্তাধীন। তাকে সাধারণত স্বামী অথবা কোর্টের উপর নির্ভর করতে হয়। তাকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা তার স্বামীর নিকট হতে অর্জন করতে হয়, অন্যথায় স্বামীর কাছ থেকে আপোষের মাধ্যমে তালাক গ্রহণ করতে হয়।
তাছাড়া একজন স্ত্রী তালাক প্রাপ্তির জন্য পারিবারিক আদালতের স্বরণাপন্ন হতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে তাকে কিছু শর্ত পূরণ হয়েছে মর্মে আদালতকে স্পষ্ট করতে হয়। শর্তগুলো হলো:
১। স্বামী কর্তৃক ভরণপোষণ না পাওয়া।
২। স্বামীর পুরুষত্বহীনতা।
৩। স্বামী দীর্ঘদিন যাবৎ নিখোঁজ রয়েছেন।
একজন স্ত্রীর তালাক প্রদান করার নিজস্ব কোন ক্ষমতা থাকে না। স্ত্রী শুধুমাত্র তখনই তালাক প্রদান করতে পারেন যখন তার স্বামী তাকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করেন। এই ধরনের তালাক ‘তালাক-ই-তাওফিজ’ নামে পরিচিত।
এই ধরনের তালাক প্রদানের ক্ষমতা স্ত্রীর থাকবে কি থাকবেনা তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার বৈবাহিক চুক্তির উপর, যা আমাদের দেশে নিহাকহ্নামা বা কাবিননামা হিসেবে পরিচিত। যদি এই ধরনের ক্ষমতার কথা কাবিননামায় উল্লেখ থাকে শুধুমাত্র তখনই একজন স্ত্রী-স্বামী অথবা আদালতের মাধ্যম ছাড়া তালাক প্রদান করতে পারে।
তাই স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ না করলে স্ত্রীর তালাক প্রদানের কোন ক্ষমতাই থাকবে না। এই ক্ষমতার অনুপস্থিতিতে স্ত্রী শুধুমাত্র তার স্বামীকে তালাক প্রদানের জন্য অনুরোধ করতে পারেন অথবা পারিবারিক আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করতে পারেন।
কিন্তু তিনি নিজে নিজেই তালাক প্রদান করতে পারেন না। এখানে প্রশ্ন থাকতে পারে কাবিননামা সম্পাদনের সময় স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা প্রদান না করেন তাহলে পরবর্তীতে কি স্বামী তা প্রদান করতে পারেন? উত্তর হচ্ছে স্বামী চাইলে পরবর্তীতেও স্ত্রীকে এই ক্ষমতা প্রদান করতে পারেন এবং এই ক্ষেত্রে আইনগত কোন জটিলতা নেই।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে বিয়ের সময় স্ত্রী যদি এই ক্ষমতা অর্জন না করেন তাহলে পরবর্তীতে তারপক্ষে এই ক্ষমতা অর্জন করা কঠিন হয়ে যায়। তাই স্ত্রীর ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে উত্তম হবে বিয়ের সময়ই উপরোক্ত ক্ষমতা অর্জন করা।
স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে স্ত্রী যখন স্বামীকে তালাক দেয় তখন সেটিকে ‘তালাক-ই-তাওফিজ’ বলে। একজন স্বামী চাইলে তার স্ত্রীকে ‘তালক-ই-তাওফিজ’ শর্ত সাপেক্ষে অথবা বিনা শর্তে প্রদান করতে পারেন।
আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে একটা ভুল ধারনা রয়েছে যে, ‘তালাক-ই-তাওফিজ’ অবশ্যই শর্ত সাপেক্ষে হবে। অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন, একজন স্বামী তার স্ত্রীকে বিনা শর্তে এই ক্ষমতা ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করলে স্ত্রী তা কোন প্রকার শর্ত ব্যতিরেকেই ব্যবহার করতে পারেন। এটা পুরোপুরি নির্ভর করবে স্বামী এবং স্ত্রীর মাঝে কি চুক্তি হয়েছে তার উপর।
বর্তমান বাস্তবতায় কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামে পরিবর্তন আনার প্রয়োজনীয়তা
আমাদের দেশে কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামের মাধ্যমে একজন স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করে থাকেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, খুব সহজেই কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামের ভুল ব্যাখ্যা করা যায়।
কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামে বলা হয়েছে, ‘স্বামী স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করিয়াছে কিনা? করিয়া থাকিলে কি শর্তে?’ সুতরাং, কাবিনামার ১৮ নম্বর কলাম অনুসারে স্বামী যদি তার স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করেন তাহলে তাকে উল্লেখ করতে হয় কি শর্তে তিনি তার স্ত্রীকে এই ক্ষমতা অর্পণ করলেন।
‘তালাক-ই-তাওফিজ’ শর্ত সাপেক্ষে হতে হবে এই ভুল ধারনাটি আমাদের দেশের বর্তমান বিবাহ চুক্তিতে (নিকাহ্নামা/কাবিননামা) পরিলক্ষিত হচ্ছে। অথচ “তালাক-ই-তাওফিজ” অনুযায়ী একজন স্বামী তার স্ত্রীকে বিনা শর্তে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পন করতে পারেন।
কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামে যদি কোন শর্তের উল্লেখ থাকে তাহলে স্ত্রী শুধুমাত্র সেই শর্তের ভিত্তিতেই তালাক প্রদান করতে পারেন। উদাহরণ স্বরূপ, যদি কোন মহিলার বিবাহের কাবিননামায় উল্লেখ থাকে যে, তার স্বামী যদি তাকে ভরণপোষণ প্রদান না করেন, তাহলে তিনি তার স্বামীকে তালাক দিতে পারবেন।
কিন্তু বাস্তবে তার স্বামী তাকে ভরণপোষণ দিলেও প্রচন্ড মারধর করেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে স্ত্রী কি তার স্বামীকে তালাক দিতে পারবেন? উত্তর হচ্ছে না, কারণ তিনি তার স্বামীর কাছ থেকে অন্য শর্তে তালাক প্রদানের ক্ষমতা পেয়েছেন। এই ক্ষেত্রে স্ত্রীকে যদি তালাক নিতে হয় তাহলে হয় তাকে তালাক প্রাপ্তির জন্য পারিবারিক আদালতে যেতে হবে অন্যথায় তার স্বামীকে তালাক প্রদানের জন্য অনুরোধ করতে হবে।
তাই কাবিননামার ১৮ নম্বর কলাম পূরণের সময় মহিলাদের আরও শতর্ক হওয়া উচিৎ সেই সাথে কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামটি সময়োউপযোগী করে ড্রাফট করা উচিৎ। উদাহরন স্বরূপ- ‘স্বামী স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করেছেন? করে থাকলে, শর্তহীন” অথবা, শর্ত সাপেক্ষে? যদি শর্ত সাপেক্ষে হয়ে থাকে, তাহলে কি শর্তে?
লেখক: শহীদুজ্জামান (সেতু)
অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
প্রাক্তন প্রভাষক, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ,
প্রাক্তন প্রভাষক (খন্ডকালিন), ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
আরটিভি/এসআর