বৃহস্পতিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৩ , ০২:৫৭ পিএম
কাঁধে ঝোলা, পান খাওয়া লাল ঠোঁট। স্মিত হাসিমাখা মুখে জর্দার ম-ম ঘ্রাণ। ঢিলেঢালা রঙিন শার্ট বা পাঞ্জাবি ছাড়া খুব একটা দেখা যায়নি মাটি ও মানুষের কবি, প্রেম ও প্রতিবাদের কবি আসাদ চৌধুরীকে। কথা বলতেন শুদ্ধ বাংলায়। সহজ-সরল মেদহীন অকৃত্রিম ভাব ও ভাষা ছিল কণ্ঠে। তবে কখনোই ভাষায় বরিশালের আঞ্চলিকতাকে উপেক্ষা করতে দেখা যায়নি তাকে।
মানুষের জন্য নির্মোহ ভালোবাসা ছিল কবির। কবিতাকে তিনি ভেবেছেন সুন্দরের মিনার ও মন্দির। সৌন্দযের্র টানে ছুটছেন দেশ-দেশান্তর। যাপন করেছেন শত-সহস্র আচ্ছন্ন কবিতা-প্রহর। শব্দের রহস্য আর জীবনের বিচিত্র রসিকতাকে লালন করে চলছিলেন ‘তবক দেওয়া পান’-এর কবি আসাদ চৌধুরী।
তার কবিতায় আছে নতুন সুর। দেশ, দেশের ঐতিহ্য, লোকায়ত জীবন, মুক্তিযুদ্ধ, প্রেম, সহজিয়া ভাব তার কবিতার উজ্জ্বলতা। আধুনিকতার নামে অকারণ দুর্বোধ্যতা তিনি এড়িয়ে চলেছেন। নিরন্তর পান চিবাতে পছন্দ করা এ মানুষটির মুখে আঠার মতো এক ঝলক হাসি লেগে থাকত। ১৯৭৫ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তবক দেওয়া পান’ প্রকাশের পর সবাই বুঝতে পেরেছিলেন, বাংলা সাহিত্যে একজন শক্তিমান কবি যুক্ত হলো। ‘সত্যফেরারী’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-
কোথায় পালাল সত্য?
সাংবাদিকের কাঠের ডেস্কে,
কাগজে, কেতাবে, পুঁথিতে, কলমে,
ইনজেকশনে, দাঁদের মলমে,
ভ্যানিটি ব্যাগে বা পকেটে, আঁচলে
ড্রয়ারে, ব্যাংকে, আয়রণ সেফে
সত্য নামক মহান বস্তু নেই তো!
মুক্তিযুদ্ধের আগুন ঝরা বহু স্মৃতি কবিতায় তুলে ধরেছেন আসাদ চৌধুরী। যুদ্ধের সঙ্গে তালমিলিয়ে কলমযুদ্ধ করেছেন তিনি। কবিতার ভেতর দিয়ে নতুন প্রজন্মকে শিখিয়েছেন ইতিহাস। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে দুঃখ ও হতাশার মিশেলে কবি লিখেছেন-
তোমাদের যা বলার ছিলো/বলছে কি তা বাংলাদেশ?
শেষ কথাটি সুখের ছিলো/ ঘৃণার ছিলো,
নাকি ক্রোধের, প্রতিশোধের/কোনটা ছিলো?
তার কবিতা ‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম’-এ লিখেছেন-
‘নদীর জলে আগুন ছিলো/ আগুন ছিলো বৃষ্টিতে/
আগুন ছিলো বীরাঙ্গনার উদাস-করা দৃষ্টিতে/
আগুন ছিলো গানের সুরে/ আগুন ছিলো কাব্যে/
মরার চোখে আগুন ছিলো/ এ-কথা কে ভাববে?/
.....আগুন ছিলো মুক্তি সেনার স্বপ্ন-ঢলের বন্যায়/
প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে কাঁপছিলো সব-অন্যায় /
... তখন সত্যি মানুষ ছিলাম/এখন আছি অল্প।
১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি আসাদ চৌধুরী বাকেরগঞ্জের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া জমিদার বাড়িতে একটি সম্ভ্রান্ত বাঙালি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আসাদ চৌধুরী আরমানিটোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৫৭ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬০ সালে তিনি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ থেকে। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অধ্যয়ন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৬৩ সালে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৬৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকে যাওয়ার পর কলেজে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে আসাদ চৌধুরীর চাকুরিজীবন শুরু। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে তিনি ১৯৬৪ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীকালে ঢাকায় স্থিত হওয়ার পর তিনি বিভিন্ন খবরের কাগজে সাংবাদিকতা করেছেন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত তিনি ভয়েজ অব জার্মারির বাংলাদেশ সংবাদদাতার দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকায় বাংলা একাডেমিতে দীর্ঘকাল চাকরির পর তিনি এর পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে-
তবক দেওয়া পান (১৯৭৫), বিত্ত নাই বেসাত নাই (১৯৭৬), প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড় (১৯৭৬), জলের মধ্যে লেখাজোখা (১৯৮২), যে পারে পারুক (১৯৮৩), মধ্য মাঠ থেকে (১৯৮৪), মেঘের জুলুম পাখির জুলুম (১৯৮৫),
আমার কবিতা (১৯৮৫), ভালোবাসার কবিতা (১৯৮৫), প্রেমের কবিতা (১৯৮৫), দুঃখীরা গল্প করে (১৯৮৭), নদীও বিবস্ত্র হয় (১৯৯২), টান ভালোবাসার কবিতা (১৯৯৭), বাতাস যেমন পরিচিত (১৯৯৮), বৃন্তির সংবাদে আমি কেউ নই (১৯৯৮), কবিতা-সমগ্র (২০০২), কিছু ফল আমি নিভিয়ে দিয়েছি (২০০৩), ঘরে ফেরা সোজা নয় (২০০৬)।
বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন কবি আসাদ চৌধুরী। তিনি আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৫), অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার (১৯৮২), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৭), অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার (২০০৬), বঙ্গবন্ধু সম্মাননা ১৪১৮ ও একুশে পদক (২০১৩) ভূষিত হন।
বাংলা সাহিত্যের তুমুল জনপ্রিয় এই কবি ৮০ বছর বয়সে ৫ অক্টোবর কানাডায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। তার মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্য হারাল জ্বলজ্বলে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।