প্রধান উপদেষ্টার স্বস্তির আশা ও প্রশ্ন জাগানো এক সংলাপ
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৃহস্পতিবারের সংলাপে বিভিন্ন ধর্মের মোট ৩২ জন প্রতিনিধি অংশ নেন৷ তাদের মধ্যে ২৬ জন বক্তব্য দেন।
সংলাপে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি আবদুল মালেকসহ ১৬ জন বিশিষ্ট আলেম অংশ নেন। তাদের মধ্যে বাংলাদেশ হেফাজতে ইসলামের আমির সাজেদুর রহমানসহ সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা ছিলেন। তারা হলেন- মুহিউদ্দিন রাব্বানী, আহমদ আলী কাসেমী, জুনায়েদ আল হাবিব ও মুনির হোসাইন কাসেমী।
আরো উপস্থিত ছিলেন, রমনার সেন্ট মেরিজ ক্যাথিড্রাল চার্চের প্রধান পুরোহিত আলবার্ট রোজারিও, পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের স্টুডেন্ট কাউন্সিলর রেভা ভেরোনিকা ডি কস্তা, বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ভিক্ষু সুনন্দ প্রিয়, রমনার হরিচাঁদ মন্দিরের ধর্মীয় সহসম্পাদক অবিনাশ মিত্র, গারো সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি খামাল জনসন মৃ।
সংলাপে আরও অংশ নেন, বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক)-এর মহাসচিব মাহফুজুল হক, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আহমদুল্লাহ, মিরপুরের আরজাবাদ মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল বাহাউদ্দীন জাকারিয়া, ফরিদাবাদ মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল আবদুল কুদ্দুছ, লালবাগ মাদ্রাসার মুহাদ্দিস মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজি, ছারছিনা দরবার শরিফের প্রতিনিধি ও দারুননাজাত মাদ্রাসার ওসমান গণি সালেহী, আহলে হাদিস অনুসারীদের প্রতিনিধি আবদুল্লাহ বিন আবদুর রাজ্জাক, মোহাম্মদপুরের কাদেরিয়ার তৈয়বিয়া আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ জসিম উদ্দিন আল আজহারী, ফরিদগঞ্জ মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষ মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান ও ধানমন্ডি আত-তাকওয়া মসজিদের খতিব মুফতি সাইফুল ইসলাম।
উপস্থিত ছিলেন চার উপদেষ্টা আ ফ ম খালেদ হোসেন, আদিলুর রহমান খান, মাহফুজ আলম ও সুপ্রদীপ চাকমা এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
এছাড়া ছিলেন কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার।
ফরহাদ মজহার ডয়চে ভেলেকে বলেন, যারা মূলত এখন আন্দোলন করছে সনাতন জাগরণ মঞ্চ, আর আছে হিন্দু মহাজোট- তাদের কেউ ছিলেন না। এটা একটা দিক। যারা ধর্মীয় প্রতিনিধি, তাদের ডাকা হয়েছে। সে কারণে যারা রাজনৈতিক প্রতিনিধি, তাদের হয়তো ডাকা হয়নি। আমি যেহতেু একটি ধারার সমর্থক, সেই কারণে আমি ওখানে গিয়েছিলাম। আর এটা অল্প সময়ের মধ্যে করা হয়েছে। তাই এটা সরকারও বলেনা যে, প্রতিনিধিত্বশীল হয়েছে। হয়তো তারা পরে আরো কথা বলবেন।
তার কথা, সরকারকে তো কথা শুনতে হবে। সভা সমাবেশ-করতে দিতে হবে। সভা-সমাবেশ তো রাষ্ট্রদ্রোহ নয়। আপনাকে ভিন্নমত শুনতে হবে, ডিসঅ্যাগ্রি করতে দিতে হবে। চিন্ময়ের নেতৃত্বে যে সনাতনী জোট হয়েছে এটা তো রাজনৈতিক সংগঠন না। তারা যে আট দফা দাবি করেছে, তা তো শোনা যায়। তারা যেসব দাবি করেছে, তার মধ্যে তো কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আমি দেখি না। তারা তিন দিন ছুটি চেয়েছে, দুই দিন দিয়েছেন। আরেক দিন দিলে অসুবিধা কী? একটি কশিন করে দেয়া যায়, তারা তাদের দাবিগুলো দেখতে পারে। তাদের সভা-সমাবেশ করতে দেবেন না, তা তো হয় না।
তিনি আরও বলেন, মাজার ভেঙে দেয়া হচ্ছে, লালনের অনুষ্ঠান করতে দেয়া হচ্ছে না। যারা মাজার ভেঙেছে তাদের আপনি গ্রেপ্তার করলেন না, চিন্ময় দাসকে গ্রেপ্তার করলেন। মাজার ভাঙার চেয়ে কি চিন্ময় বড় অপরাধ করেছে? সে যদি উসকানি দিয়ে থাকে তা কি মাজার ভাঙার চেয়ে বড় অপরাধ?
ফরহাদ মজহার এও বলেন, ভারতের কুৎসিত প্রোপাগান্ডা মোকাবেলা করার জন্য তাদের ডাকা হয়েছিল। তাদেরকেই তারা ডেকেছেন, যারা তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে এই প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে কাজ করতে পারবেন। তারাও সুন্দর কথা বলেছেন। তারা কাজ করবেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তবে সংখ্যালঘু নির্যাতন যে হয়নি, তা বলা যাবে না। সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েছে। গরিব মানুষের ওপর আঘাত এসেছে। তাদের জায়গা দখল হচ্ছে। আজকে আওয়ামী লীগ নাই, আওয়ামী লীগের কুকান্ডগুলো ভিন্ন একটি দল করছে। এই তো কথা। ফলে সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়নি এটা তো আমি বলবো না।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলেছি বৈঠকে অংশ নেয়া মিরপুরের আরজাবাদ মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল বাহাউদ্দীন জাকারিয়া বলেন, আমরা সেখানে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার চলছে, তা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলেছি। সেখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, নৃগোষ্ঠীসহ সবার প্রতিনিধি ছিলেন। তারাও আমাদের সাথে একমত হয়েছেন। তারা নিরাপত্তাহীনতার কথা বলেননি, তবে আরো নিরাপত্তা চেয়েছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হিন্দুদের যেসব সংগঠন নিয়ে বিতর্ক আছে, তাদের হয়তোবা সরকার ডাকেনি। তবে তাদের মন্দিরের পুরোহিতরা ছিলেন।
রমনা হরিচাঁদ মন্দিরের পুরোহিত অবিনাশ মিত্র বৃহস্পতিবার বৈঠকের পর সংবাদমাধ্যমকে বলেন, বিভিন্ন ধর্মের গুরুরা উপস্থিত ছিলেন। বিভিন্ন রকমের কথা সবাই শুনেছেন। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা সবার কথা শুনেছেন। তিনি সে মোতাবেক আগাবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। আমরা দেশে ভালো আছি, কারো মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। ওখানে বসে তাদেরই লোক প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। এখানে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খৃষ্টান সবাই এক৷ কারো মধ্যে বিভেদ নেই।
বাংলাদেশে সব জাতি সমানভাবে বাঁচতে চায়। আমাদের এক ভাইকে কে মেরেছে, সেটা খুঁজে বের করতে হবে৷ কিন্তু এটাকে পুঁজি করে বাইরের রাষ্ট্র বড় কিছু তৈরি করবে- সেটা আমরা চাই না। হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই হিসেবে সবার অধিকার নিয়ে বাঁচতে চাই। কেউ অন্যায় করলে তাকে চিহ্নিত করে বিচার করা হোক।
প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে নাম প্রকাশ না করে এক কর্মকর্তা বলেন, আমার মনে হয়েছে, এখানে যারা ইমাম, ধর্মগুরু, পুরোহিত তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কোনো সংগঠন নয়, প্রতিষ্ঠানের নেতাদের ডাকা হয়েছে।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক দীপঙ্কর ঘোষ বলেন, আমরাই দীর্ঘদিন ধরে সংখ্যালঘুদের অধিকার, নির্যাতন নিয়ে কথা বলে আসছি। আমাদের কাছেই এই সংক্রান্ত সঠিক তথ্য আছে। সরকার আমাদের বাদ দিয়ে সঠিক তথ্য পাবে বলে মনে করি না। ১৯ সেপ্টেম্বর আমরা একটা তালিকা প্রকাশ করেছি। এরপরের ঘটনাগুলোর তথ্যও আমরা সংগ্রহ করছি। ওই তালিকা আমরা সরকারকে দিয়েছি। সেটা সরকার তদন্ত করে দেখতে পারে। আমরা তো তদন্ত করে দেখার অনুরোধ করেছি। এখনো তো তার কোনো রেজাল্ট পাইনি। আর আমরা এই তালিকা যে এখন করেছি, তা নয়। প্রতিবছরই আমরা করি, বলেন তিনি।
যাদের ডাকা হয়েছে, তারা আমাদের প্রতিনিধিত্ব করেন না সনাতন জাগরণ মঞ্চের প্রতিনিধি গৌরাঙ্গ দাস প্রভু বলেন, যাদের ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তারা আমাদের প্রতিনিধিত্ব করেন না। তাদের কেউ চেনেন না। তারা কী তথ্য দেবেন? তারা কী প্রকৃত সত্য জানেন? রমনা মন্দিরের একজনকে সেখানে নেয়া হয়েছে, তাকে আমরা চিনি না। তিনি কী বলেছেন তা-ও আমরা জানি না, বলেন তিনি।
তার কথা, প্রকৃত তথ্য জানতে হলে প্রতিনিধিত্বশীল বৈঠক হতে হবে।
সরকার জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ হিসেবে মঙ্গলবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সঙ্গে, বুধবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এবং বৃহস্পতিবার ধর্মীয় নেতা ও গুরুদের সঙ্গে বৈঠক করেছে।
আরটিভি/এএইচ
মন্তব্য করুন