বাংলাদেশ নিয়ে ভুয়া খবরে সয়লাব ভারতীয় মিডিয়া, নেপথ্যে যে কারণ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকেই এক ধরনের টানাপোড়েন চলছে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে। তাতে অন্যতম ক্রীড়ানকের ভূমিকা পালন করছে ভারতীয় বেশ কিছু গণমাধ্যম। সংখ্যালঘু নিপীড়ন ইস্যুতে একের পর এক অতিরঞ্জিত ও ভুয়া সংবাদ প্রকাশ করে চলেছে তারা। ভারতীয় মিডিয়ার যাচাই-বাছাইহীন সংবাদ প্রকাশের এ প্রবণতা আরও বেড়েছে বাংলাদেশের হিন্দু সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণ দাস গ্রেপ্তারের পর থেকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক ভাষণ, মূলধারার গণমাধ্যমের প্রতিবেদন এবং সামাজিকমাধ্যম– সব মিলিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে আখ্যান তৈরি করা হচ্ছে ভারতে, তা দেশটির হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে অনেক সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে ফেলছেন। ফলে, বাংলাদেশ সম্পর্কে এক ধরনের অবিশ্বস্ততা, ক্ষেত্রবিশেষে বিদ্বেষ তৈরি হচ্ছে ভারতীয়দের মনে।
বন্ধুপ্রতীম দেশটির মিডিয়ার এমন আচরণ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার সংশ্লিষ্টদের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলো দাবি করছে, জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারছে না ভারত সরকার।
৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া কেন অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে, কীভাবে মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতে ভুয়া খবর ঠাঁই করে নিচ্ছে, তা বিশ্লেষণ করার প্রয়াস চালিয়েছে বিবিসি বাংলা।
সংবাদমাধ্যমটির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ভুয়া খবর ছড়াচ্ছে সামাজিকমাধ্যমে। মূলত, তথ্যের বাছ-বিচার ছাড়া সেগুলোই স্থান পাচ্ছে ভারতের বিভিন্ন খবরের কাগজ ও টিভিতে।
‘নেটওয়ার্ক ১৮’ নামে একটি সর্বভারতীয় টিভি নিউজ নেটওয়ার্কের পূর্বাঞ্চলীয় সম্পাদক বিশ্ব মজুমদারও বিষয়টি স্বীকার করছেন অকপটে। তার ভাষ্যমতে, কোনো তথ্য বা ভিডিও পেলে সেটা যাচাই বাছাইয়ের ব্যাপারটাই এখন উঠে গেছে। ২৫-৩০ বছর ধরে কাজ করা সাংবাদিকদের সঙ্গে এখনকার সাংবাদিকদের কাজের ধরনটাই বদলে গেছে। এরা যেকোনো ঘটনা ঘটলে সেটা যাচাই না করেই অন্য চ্যানেলে দেখতে পেলেই তা চালিয়ে দেয়। ব্রেকিং নিউজের প্রতিযোগিতা চলছে! কে কত আগে সেনসেশন তৈরি করতে পারবে, সেই লড়াই চলছে চ্যানেলগুলোর মধ্যে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে যা দেখানো হচ্ছে, তা কোনভাবেই সাংবাদিকতা নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ব মজুমদার। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে মূল যে সমস্যাটা হচ্ছে, তা হলো সেখানে যে কী ঘটছে তার বাস্তব চিত্র আমরা খুব একটা পাচ্ছি না। এর কারণ হলো আমরা যারা কলকাতা থেকে চ্যানেল চালাই, তাদের কারও বাংলাদেশে কোনো প্রতিনিধি নেই এই মুহূর্তে। যা পাওয়া যাচ্ছে, তার একটা বড় অংশ আসছে সামাজিকমাধ্যম থেকে। এর ভিত্তিতে এটা বলা যায় না যে বাংলাদেশের পরিস্থিতি খুব খারাপ বা খুব ভালো।
ভারতের তথ্য যাচাই ও ভুয়া খবরের খোঁজ দেয় এরকম একটি ওয়েবসাইট ‘অল্ট নিউজ’ গত কয়েক দিনে বাংলাদেশসংক্রান্ত বেশ কয়েকটি খবর খুঁজে পেয়েছে, যেগুলোতে ‘বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপরে আক্রমণ’ হচ্ছে বলে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয়েছে।
এসব ভুয়া টুইট বা ফেসবুক পোস্টগুলোতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হ্যাশট্যাগ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে ‘সেভ বাংলাদেশি হিন্দুজ’ বা ‘অল আইজ অন বাংলাদেশি হিন্দুজ’ অথবা ‘প্রে ফর বাংলাদেশি হিন্দুজ’। আরও একটি বাক্য এ ধরনের ভুয়া পোস্টগুলোতে দেখা গেছে, যার মোটামুটি বাংলা অনুবাদ হলো ‘জিহাদিরা বাংলাদেশের হিন্দুদের কেটে ফেলছে অথচ বিশ্ব একেবারে চুপ করে আছে’।
অল্ট নিউজের সম্পাদক প্রতীক সিনহা বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলা হচ্ছে এটাও যেমন ঘটনা, তেমনই এটাও সত্য যে বহু ভুয়া খবর, অসত্য তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করা হচ্ছে। এর মধ্যে অনেক ভুয়া তথ্যই আবার মূলধারার গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হচ্ছে।
বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে একইসঙ্গে তিনি এও বলেন, ভুয়া তথ্য পরিবেশন যে শুধুমাত্র বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে হচ্ছে, তা নয়। ভারতের বাইরের বিভিন্ন ঘটনায়; যেমন ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত বা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়েও এ রকম ভুয়া তথ্য পরিবেশনের ঘটনা আমরা দেখেছি।
এদিকে ভারতীয় গণমাধ্যমের একাধিক বিশ্লেষক আবার বলছেন, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকেই বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের গণমাধ্যমে একটা বিরোধিতার সুর দেখা যাচ্ছিল। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের পর তা চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে।
পুণের এমআইটি এডিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণমাধ্যম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সম্বিত পাল বলেন, ভারতের মিডিয়ায় এর আগে যেভাবে ভারত-বন্ধু শেখ হাসিনার প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন দেখিয়েছে, ঠিক সেই পথেই অধিকাংশ মিডিয়া হাসিনা সরকারের পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূস পরিচালিত অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। কারণ, তারা মনে করছে যে বাংলাদেশের এই সরকার ভারতের বর্তমান শাসকদলের বিরোধী।
তার ভাষ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর আক্রমণের ঘটনা নিয়ে ভারতের মিডিয়া এতটা উচ্চগ্রামে খবর করেনি। কারণ, তখন শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি মোদি ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ভারতীয় মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তারা ওই অবস্থান নিয়েছিল। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলোর ভূমিকাও পাল্টে গেছে।
বিবিসি বাংলার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের বর্তমান সরকারের সাম্প্রতিক আচরণের পেছনে আরেকটি কারণ হিন্দু ভোটব্যাংক। বাংলাদেশের হিন্দু সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণ দাস গ্রেপ্তারের পরে গত দেড় সপ্তাহ ধরে পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় যত বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে, সেখানে হিন্দুত্ববাদী নেতাদের মুখে একটা কথা বার বার শোনা গেছে যে হিন্দুরা যদি ঐক্যবদ্ধ না হন, তাহলে ভারতেও একই পরিস্থিতি হবে। হিন্দুরা যেমন বাংলাদেশে আক্রান্ত হচ্ছেন, ভারতেও তেমনটা হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে বলে একটা আখ্যান তৈরি করার চেষ্টা করছেন হিন্দুত্ববাদী নেতারা।
অল্ট নিউজের সম্পাদক প্রতীক সিনহার ভাষ্য, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে শাহিনবাগের প্রতিবাদ আন্দোলন অথবা ইসরায়েল বা এখন বাংলাদেশ– সব ক্ষেত্রেই ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে আসলে ঘুরপথে ভারতীয় মুসলমানদেরই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হচ্ছে। এখানকার মুসলমানদের ওপরে বিদ্বেষ ছড়ানো যাতে যুক্তিযুক্ত হিসাবে দেখানো যায়– সেই আখ্যান তৈরির প্রচেষ্টা চলছে সরকারপন্থী মিডিয়াগুলোতে।
অধ্যাপক সম্বিত পালও বলেন একই কথা। তার মতে, সাম্প্রদায়িক বিভাজনে যাদের লাভ হবে, তারাই ভুয়া খবর ছড়াতে উদ্যোগী হয়েছেন। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের জন্য এর থেকে ভালো বিষয় আর হতে পারে না। ঠিক যেভাবে ভারতে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরুদের মধ্যে টেনশনকে নিজেদের পক্ষে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য ভুয়া খবর ছড়ানো হয়, ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশের ঘটনা নিয়েও তাই হচ্ছে। মূলত, এক্ষেত্রে বাংলাদেশের হিন্দুদের নিরাপত্তার চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় কাজ করছে নির্বাচনী স্বার্থ।
আরটিভি/এসএইচএম/এস
মন্তব্য করুন