ঢাকাশুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫, ২৯ ফাল্গুন ১৪৩১

মেধাবীদের অবমূল্যায়ন!

মাহমুদুল বাসার (কলামিস্ট ও সাংবাদিক)

শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ , ১১:০৫ পিএম


loading/img

আমার কাছে এসেছিল কয়েকজন প্রদীপ্ত তরুণ ও একজন তরুণী। তারা ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষায় পাস করে বেকার বসে আছে। তাদের যোগ্যতা অনুসারে চাকরি দেয়া হয়নি। তাই তারা আমাকে অনুরোধ করতে এসেছিল কিছু লিখতে। ওদের ম্লান মুখগুলো বারবার মনে পড়ছে। আমরা তো মেধাবী নই, বিসিএসের ভেতরের খবর, প্রশাসনের ভেতরের খবর বা গোমর অতোটা জানি না। আমরা তো ভেবেছিলাম, বিসিএস পরীক্ষায় কোয়ালিফাই করা মানেই চাকরি। এখন ওরা যা বললো, আমাকে বিস্তর কাগজপত্র দেখালো, তাতে বুঝলাম। না, ব্যাপারটা তা নয়। বিসিএস পরীক্ষায় অনেকগুলো কঠিন দরজা পার হয়ে এসে যোগ্যতা ও মেধা যাচাইয়ে উত্তীর্ণ হয়েও মেধাবী ছেলেমেয়েরা চাকরি পাচ্ছে না।

বিজ্ঞাপন

এটা তো মর্মান্তিক দুঃসংবাদ। ওরা তো দয়া ভিক্ষা চাচ্ছে না। বিসিএস পরীক্ষা বছরে বছরে নেয়া হয় কেনো? চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতিতেই তো পরীক্ষা নেয়া হয়। সাদামাটা বুদ্ধিতে বুঝি যে, পরীক্ষায় যারা কোয়ালিফাই করবে তারা যোগ্যতা অনুসারে চাকরি পাবে। এটাও আমরা বুঝি যে, প্রশাসনে যেসব পদ খালি আছে, তা পূরণ করার টার্গেট নিয়ে বিসিএস পরীক্ষা আহ্বান করা হয়। পরীক্ষায় প্রাপ্ত সর্বোচ্চ নম্বরের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রার্থীদেরই ক্যাডার হিসাবে ঘোষণা করা হবে। বাকিদের অকৃতকার্য করা হবে। উত্তীর্ণরা নিয়ম মোতাবেক চাকরিতে যোগদান করার সুযোগ পাবে। কিন্তু ব্যাপারটি তেমন সরল পথে অগ্রসর হচ্ছে না। নানা ক্যারিকেচার হচ্ছে বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে।

আমরা সহজ ভাবে বুঝি যে, সারা দেশের প্রশাসনে কতো জন বিসিএস পাস অফিসার লাগবে তা সনাক্ত করে, সে টার্গেট সামনে রেখে বিসিএস পরীক্ষা নেয়া হয়। যারা আমার কাছে এসেছিল, তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, ব্যাপারটা অমন সরল নয়। যথেষ্ট ঘোরপ্যাঁচ আছে এর মধ্যে। প্রতি বিসিএস পরীক্ষায় যতো ছেলেমেয়ে যোগ্যতার সাক্ষর রেখে উত্তীর্ণ হয়, তাদের সবাইকে চাকরি দেয়া হয় না। পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের একদলকে করা হয় ক্যাডার, অন্য দলকে করা হয় নন-ক্যাডার। অবাক কাণ্ড! একই মেধায় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কেউ ক্যাডার, কেউ নন-ক্যাডার?

বিজ্ঞাপন

এই নন-ক্যাডারদের মধ্য থেকে কেউ ২য় শ্রেণির চাকরি পায়, অধিকাংশই চাকরি পায় না। অথচ মেধা যাচাইয়ে উত্তীর্ণ ছেলেমেয়েদের চাকরি না দিয়ে ফের বিসিএস পরীক্ষা আহ্বান করা হচ্ছে। এটাকে তুঘলকি কাণ্ড ছাড়া কী বলবো! ফেল করে ফের পরীক্ষা দেয়া যায়। কিন্তু পাস করে আবার একই পরীক্ষা দেয়া বিষ খাবার মতো বিরক্তিকর ব্যাপার। তারপর আবার মেধা যাচাইয়ে প্রতিটি ধাপে উত্তীর্ণ হয়ে আবার পরীক্ষায় পাস করে নন-ক্যাডার তালিকায় স্থান পাবে।

দেশের মেধাবী তরুণ তরুণীদের ওপর এ অবিচার করার কারণ কী? বিসিএস পাস করে কেনো তারা চাকরি পাবে না? চাকরি দিতে না পারলে তাদের পরীক্ষায় কোয়ালিফাই করা হয় কেনো? তাদের মেধার মূল্যটা থাকলো কোথায়? বিভিন্ন সূত্র থেকে আমরা জেনেছি, দেশের প্রশাসনে অনেক পদ খালি আছে। সেসব পদগুলোতে ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষায় পাস করা মেধাবীদের ছেলেমেয়েদের চাকরি দেয়া হচ্ছে না। যোগ্যতা যাচাইয়ে উত্তীর্ণ বেকারদের চাকরি না দিয়ে নতুন করে পরবর্তী বিসিএস পরীক্ষা আহ্বান করা হচ্ছে। আবার পাস করা পাস করার জন্য পরবর্তী বিসিএস পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবে। ততো দিনে তো অনেকের বয়স চলে যাবে। অনেকে হতাশায় পরীক্ষায় খারাপ করবে।

ভুক্তভোগীরাই জানে, একটা বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতে গেলে কতো শত প্রামাণিক কাগজপত্র ফটোকপি করতে হয়, তা সত্যায়িত করার জন্য গেজেটেড অফিসারদের দুয়ারে দুয়ারে ধরনা দিতে হয়। খরচের সীমা নাই, হয়রানি শেষ নেই। তাছাড়া সরকারেরও ঝামেলা এবং খরচের শেষ নেই এক একটা বিসিএস পরীক্ষা নিতে। কোনো সাধারণ ছেলে মেয়ে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেয়ারই যোগ্যতা রাখে না। যেসব ছেলেমেয়ে ছোটকাল থেকে মেধাবী, প্রতিটি ক্লাসে ১ম বা ২য়- ৩য় স্থান অধিকার করে এবং উচ্চতর ডিগ্রিতেও ১ম শ্রেণি পেয়ে থাকে এবং যারা পরিশ্রমী, অধ্যবসায় তারাই বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে থাকে। আর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় সর্বোচ্চ মেধাবীরা।

বিজ্ঞাপন

যারা আগাগোড়া ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮/১৯ ঘণ্টা পড়াশোনা করে। এরাই বিসিএস পরীক্ষায় পাস করে। আর এরা চাকরি না পেয়ে বেকার বসে, দুশ্চিন্তায় দিন গুজরান করবে? এটা তো মেধাবীদের প্রতি চরম অবমূল্যায়ন। মেধাবী ছেলেমেয়েরা দেশের সম্পদ। এ সম্পদের সদ্ব্যবহারের পরিবর্তে যদি অবমূল্যায়ন করা হয় তাহলে দেশেরই মারাত্মক ক্ষতি। প্রশাসনে মেধাবী ছেলেমেয়েদের নিয়োগ দেয়ার দরকার আছে। কূটনীতিক ফারুক চৌধুরীর লেখাগুলো পড়ার পর ভেবেছি, এমন একজন মেধাবী লোক যদি কোনো কারণে চাকরি না পেতেন, বাংলাদেশরই ক্ষতি হতো। সব সরকারই তাকে কাজে লাগিয়েছেন।

বিসিএস- বিশেষ করে ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষায় পাস করা ছেলেমেয়েদের চাকরি না দেয়ার ফল এ দাঁড়াতে পারে যে, সেখানে তদ্বির করে কিংবা টাকা দিয়ে অযোগ্য ছেলেমেয়েরা পদগুলো দখল করবে। আজকাল তো টাকার খেলা হচ্ছে সব জায়গায়। যোগ্যতা যাচাই পরীক্ষায় টিকেয়েও কয়েক লাখ টাকা দিয়ে চাকরি কিনে নিতে হয় বলে শুনেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সব বিষয়ে নখদর্পণে রাখা সম্ভব হয় না। এজন্য দেশের উন্নতির জন্য প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে টিমওয়ার্ক হবার দরকার আছে। টিম গড়ে উঠলে- যদি সৎ দেশপ্রেমিকদের দিয়ে টিম গঠন করা হয়-বাংলাদেশের প্রশাসনের সর্বস্তরের ন্যায় বিচার কায়েম হবে। মেধাবীরা দেশের সেবা করার সুযোগ পাবে। তারাই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমাদের দেশে একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে, শুধু রাজনীতিবিদরাই দেশপ্রেমের পরিচয় দেবে, আর তার ফল ভোগ করবে অন্যরা। এজন্য আমলাদের, প্রশাসনের অনেক উঁচু পদের লোকদের অনৈতিক ও কারসাজি সম্পর্কে মানুষ কোনো ধারণায় রাখে না।

বিসিএস পরীক্ষায় সর্বোচ্চ মেধাবী ছেলেমেয়েরা পাস করে চাকরি পাচ্ছে না এক শ্রেণির আমলাদের হৃদয়হীনতা অনৈতিক কারণ এবং আমলাদের পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে। যে সরকারই ক্ষমতাই আসুক, ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থাকে আমলাদের পকেটে।

পাকিস্তান আমলে এক আমলা আবুল মনসুর আহমেদকে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমাদের প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকে আমরা পকেটে রাখতে পারি। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনেও আমলাতন্ত্রের শক্ত হাত আছে। তাই আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিনীত অনুরোধ জানাবো, বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, নন-ক্যাডারভুক্তদের চাকরি দেয়ার পর যেসব পদ খালি থাকে তার ভিত্তিতে পরবর্তীতে বিসিএস পরীক্ষা আহ্বান করা হোক। চাকরির জন্য দিবস রজনী পরিশ্রম করে, রাত জেগে পড়াশুনা করে যোগ্যতায় টিকে চাকরি পাবে না, এ অন্যায় দেশের প্রতি করা হয়। এর প্রতিকার প্রার্থনা করছি আমরা। মেধাবীদের মূল্যায়ন করার আবেদন জানাচ্ছি।

ডিএইচ

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |