এক গৃহবধূর কাছে সাত লাখ টাকা ঘুষ দাবির ঘটনায় রাজশাহী চারঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুবুল আলমকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তাকে এক আদেশে চারঘাট থানা থেকে প্রত্যাহার করে রাজশাহী পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে।
রোববার (১৭ সেপ্টেম্বর) রাজশাহী জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মো. রফিকুল আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এর আগে গত ১৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে ওসির কোয়ার্টারের শয়নকক্ষে ডেকে নিয়ে সাহারা বেগম (২৮) নামের ওই গৃহবধূর কাছে সাত লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন ওই ওসি।
পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মো. রফিকুল আলম জানান, ওই ঘটনায় তদন্তের জন্য তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটিকে দ্রুত রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, শনিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাজশাহী পুলিশ সুপার বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী গৃহবধূ। অভিযোগের অনুলিপি সরাসরি ও ডাক যোগে পুলিশের আইজিপি, রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি ও রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নসহ গণমাধ্যম অফিসে পাঠানো হয়েছে। অভিযোগের অনুলিপির সঙ্গে ৬ মিনিটি ৫৩ সেকেন্ডের ওসির একটি অডিও রেকর্ড পাঠানো হয়েছে। গৃহবধূ সাহারা বেগম চারঘাট থানার চামটা গ্রামের আবদুল আলিম কালুর স্ত্রী। কালু বেশ কিছুদিন ধরে কারাগারে আছেন। আবদুল আলিম কালু গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে শলুয়া ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড থেকে সদস্য পদে নির্বাচন করে। এতে স্থানীয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। এর জেরে মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে সাহারা বেগম জানিয়েছেন। গত ১৩ সেপ্টেম্বর চাঁদাবাজির অভিযোগ করতে গেলে গৃহবধূ সাহারা বেগম ও তার ছেলে রাব্বিকে নিজের শয়নকক্ষে ডেকে নেয় ওসি মাহবুবুল আলম। প্রথমে তাদের কাছ থেকে ওসি মোবাইল ফোন নিয়ে নেয়। এরপর কথা বলতে শুরু করেন ওসি।
ফাঁস হওয়া ওই অডিও রেকর্ডে ওসি মাহবুবুল আলমকে বলতে শোনা যায়, নির্বাচন করতে মন্ত্রী আমাকে গাইবান্ধা থেকে এখানে নিয়ে এসেছে। আমি তার কথা ছাড়া কারও কথা শুনি না। এরপর চারঘাট এলাকায় গিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের ধরে মামলা দেওয়ার জন্য জেলা ডিবির ওসির সমালোচনা করেন তিনি। এ সময় তিনি বলেন, দুই লাখ টাকা দেন কালকেই ডিবির ওসিকে বদলি করে দিব (ডিবির ওসি আব্দুল আলিম কালুকে গ্রেপ্তার করেছিল)।
এরপর গৃহবধূ সাহারা বেগমকে ওসি বলেন, আপনার স্বামী আমার অনেক ক্ষতি করে গেছে (ওসির বিরুদ্ধে এসপি অফিসে অভিযোগ করেছিল)। এবার আপনার পরিবারের কাউকে ধরলে ১০ লাখ টাকার নিচে ছাড়াতে পারবেন না। এরপর ওসি বলেন, এখনও তোমার গায়ে আচর দেয়নি। বহুত ফাঁকি দিয়েছো। কালকে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে আসবা। এখন সেরকম সময় নয় যে কেউ পয়সা খায় না। সবাই পয়সা খাচ্ছে। এমন কেউ বাদ নেই যে পয়সা খাচ্ছে না। পুরো জেলা পয়সা খাচ্ছে। এখানে আমার থানা চালাতে মাসিক অনেক টাকা লাগছে। আমি স্যারকে কথা দিয়ে এসেছি। স্যারের এখন কি কি লাগবে পাঁচ লাখ টাকা… সাত লাখ টাকা লাগবে। আমি বলেছি আমি চেষ্টা করবো। স্যারকে বলেছি এখানে মাদক ছাড়া কিছু নেই।
ওসি আরও বলেন, মুক্তা (চারঘাটের মাদক সম্রাট নামে পরিচিত) অ্যাকশন নিতে পারবে না, শুভ (ছাত্রলীগ নেতা ও মাদক কারবারি) অ্যাকশন নিতে পারবে না। তোমরা পাঁচ লাখ টাকা দিতে পারবা? ধরে ওদের চালান দিয়ে দিব। থাকি না থাকি ওদের সাইজ করবো। তোমরা বাইরে থেকে ব্যবসা (মাদক ব্যবসা) করবে।
জেলা ডিবির ওসি আতিকুর রেজা সরকার আতিকের আবারও সমালোচনা করে অডিওতে ওসিকে আরও বলতে শুনা যায়, নির্বাচনের আগে শুভকে ধরতে পারবো না। কথা সব ভেঙে বলবো না। কথা সব হয়ে গেল; যদি আতিকের বদলি চাও দুই লাখ টাকা দাও। কালকেই আতিকের বদলি হয়ে যাবে।
চারঘাট থানার ওসি মাহবুবুলকে আরও বলতে শোনা যায়, যে জায়গার ক্ষমতা সেখানেই। পাঁচ লাখ আর দুই লাখ সাত লাখ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করো। আতিক বাদ, ওই দুজনকে (মুক্তা ও শুভ) ট্যাকেল দেওয়ার দায়িত্ব আমার। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরে মন্ত্রীকে বলে ওই দুজনকে ধরে গ্রেপ্তার করে চালান করে দিব। আমার সব ওপরের লাইন। যে টাকা দিবা, এই টাকাই ওপরে কাজ করবে। অডিওতে গৃহবধূ সাহারা বেগমের সুন্দর চেহারা নিয়েও মন্তব্য করতে শোনা যায় ওসিকে।
সাহারা বেগম বলেন, আমার স্বামী দীর্ঘদিন যাবত পুলিশ ও র্যাবের সোর্স হিসাবে কাজ করে। চারঘাট এলাকায় তার সোর্সের মাধ্যমে অনেক মাদক র্যাব-পুলিশ আটক করেছে। এ ছাড়াও গত নির্বাচনে ইউপি সদস্য পদে নির্বাচন করেন। এরপর থেকে এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী মুক্তার, শুভ ও সাব্বিরের সঙ্গে আমার স্বামীর বিরোধ বাধে। এর জের ধরে আমার স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করায় তারা।
তিনি আরও বলেন, চারঘাটের চামটা গ্রামের আনজুর ছেলে মুক্তা, শিবপুর গ্রামের সাইমুদ্দিনের ছেলে সাব্বির ও শলুয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ শুভ আমার কাছে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। একই সঙ্গে টাকা না দিলে মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেয়। সেই অভিযোগ করতে থানা গেলে ওসি সাত লাখ টাকা ঘুষ দাবি করে, আমাকে মাদকের ব্যবসা করতে বলে। তাতে আমি রাজি না হলে, মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেয়।
এ বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও ওসি মাহবুবুল আলম ফোন রিসিভ করেননি। তাই তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।