‘সরকারি চাকরির আবেদনই করত না মুগ্ধ, অথচ প্রাণ দিলো’

ডয়েসে ভেলে

বৃহস্পতিবার, ০১ আগস্ট ২০২৪ , ০৯:৩৭ এএম


‘সরকারি চাকরির আবেদনই করত না মুগ্ধ, অথচ প্রাণ দিলো’

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে সহিংসতায় বাংলাদেশ সরকারের হিসেব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ১৫০ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যদিও স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোর তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত ২১০ জনের অধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে যাদের মৃত্যু সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে তাদের মধ্যে অন্যতম মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ।

বিজ্ঞাপন

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের মধ্যে খাবার পানি ও বিস্কুট বিরতরণ করতে গিয়ে গত ১৮ জুলাই উত্তরার আজমপুরে সংঘর্ষের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মুগ্ধ।

মুগ্ধ ২০২৩ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক শেষ করেন। এরপর ঢাকায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি) প্রফেশনাল এমবিএ করছিলেন। মৃত্যুর পরও এই শিক্ষার্থীর গলায় ঝুলেছিল রক্তমাখা বিইউপি আইডি কার্ডটি।

বিজ্ঞাপন

মুগ্ধর মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তের ছোট একটি ভিড়িও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। যেটি পোস্ট করেন মুগ্ধর যমজ ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ। যেটি ভাইয়ের সর্বশেষ স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণ করে রেখেছেন স্নিগ্ধ।

সেই ভিডিও দেখা যায়, হাতে অনেকগুলো পানির বোতল নিয়ে হাঁটছেন মুগ্ধ। আর আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য করে বলছেন, ‘এই পানি লাগবে পানি, পানি লাগবে পানি।’ তার ডাকে সাড়া দিয়ে অনেকে তার কাছ থেকে পানি ও বিস্কুট চেয়ে নিচ্ছেন। মৃত্যুর আগ মুহূর্তের মুগ্ধর এই মুগ্ধতা ছড়ানোর ভিডিও এখন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

মুগ্ধর হাস্যোজ্জ্বল ছবি এখন ফেসবুকে ছড়িয়েছে। মুগ্ধর বন্ধু-পরিজনরাও তার হাস্যোজ্জ্বল ছবি পোস্ট করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে করে নানা স্মৃতিচারণ করছেন।

বিজ্ঞাপন

বন্ধুরা বলছেন, মুগ্ধর সরকারি চাকরির প্রতি তেমন কোনও আকর্ষণ ছিলো না। কখনও সরকারির জন্য আবেদন করার ইচ্ছাও দেখা যায়নি তার মধ্যে। অথচ এই সরকারির চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে গিয়ে তাদের প্রিয় বন্ধুর মৃত্যু হয়েছে- এটাই তাদের জন্য বড় কষ্টের।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুগ্ধর বন্ধু ও রুমমেট ছিলেন রবিউল। প্রিয় বন্ধুকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কিছুটা আবেগ প্রবণ হয়ে পড়েন তিনি।

রবিউল ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি আর মুগ্ধ একই রুমে থাকতাম। স্নাতক শেষ করার পর সে ঢাকায় চলে যায়। আমাদের দুই জনের অনেক মজার-মজার স্মৃতি রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘মুগ্ধর বন্ধু হিসেবে আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগার জায়গা হচ্ছে, সে হয়তো কোনোদিন সরকারি চাকরিতে আবেদেন জন্য ফরম তুলতো না। অথচ সেই চাকরির জন্য তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে।’

মুগ্ধ ফ্রিল্যান্সিং করতেন বলে উল্লেখ করে রবিউল বলেন, ‘সেখান থেকে সে ভালো টাকাও আয়ও করতেন। ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে তার সব রকমের আগ্রহ ছিল।’

মুগ্ধকে হারিয়ে এখন পুরো পরিবার শোকে আচ্ছন্ন। মা-বাবা সারাক্ষণ ছেলের জন্য দোয়া ও স্মৃতিকে নিয়ে পড়ে আছেন। প্রিয় ভাইকে হারিয়ে অন্য ভাইরাও শোকাহত।

মুগ্ধর বড় ভাই মাহমুদুর রহমান দীপ্ত। তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, ‘মুগ্ধর লাশের ময়নাতদন্ত করানো হয়নি। পরিবারের পক্ষ থেকে এই নিয়ে কোনও ধরণের মামলায় যাবো না আমরা।’

তিনি বলেন, ‘আমরা ভাই হারানোর শোক কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার বাবা-মা ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গির। তারা মনে করেন, আল্লাহর ইচ্ছার মুগ্ধর মৃত্যুর হয়েছে। ছেলে সেখানে আছেন ভালো আছেন। সব সময় ছেলে জন্য দোয়া করে যাচ্ছেন তারা।’

জামায়াত-শিবির, ছাত্রদলের উদ্দেশে করে মৃত্যুর আগের মুগ্ধ এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘ছাত্র আন্দোলনটাকে রাজনৈতিক বানাবেন না’- এই প্রসঙ্গে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘আমি এবং আমার ভাইয়েরা কখনও রাজনীতি করিনি। আমার ভাই মানুষকে সহযোগিতা করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। তার মৃত্যু নিয়ে কোনও রাজনীতি হোক, সেটাও আমরা চাই না।’

মুগ্ধর যমজ ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ। তারা শুধু ভাই নয়, একে-অপরের ভালোও বন্ধু ছিলেন মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ। দুই ভাইয়ের একসঙ্গে রয়েছে অনেক স্মৃতি। এখন ভাইকে হারিয়ে সেই স্মৃতি নিয়ে বেচেঁ আছেন স্নিগ্ধ।

পরিবারের পক্ষ থেকেও ভাইয়ের মৃত্যু নিয়ে কোথাও কোনও কথা বলতে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে স্নিগ্ধকে। মূলত নতুন করে কোনও ধরণের ঝামেলায় জড়াতে চায় না মুগ্ধর পরিবার।

স্নিগ্ধ বলেন, ‘মুগ্ধর মৃত্যুর নিয়ে আমাকে কথা বলতে পরিবারের পক্ষ থেকে নিষেধ করা হয়েছে।’

মুগ্ধ মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত আন্দোলকারীদের মধ্যে পানি ও বিস্কুট বিরতণের ২৭ সেকেন্ডের ভিড়িও প্রসঙ্গে স্নিগ্ধ বলেন, ‘আমি প্রথম এই ভিড়িওটি ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম। সেখানে থেকে এখন সেটি বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে।’

স্নিগ্ধ ফেসবুকে ভাইয়ের পানি বিতরণের ছবি পোস্ট করে লেখেন- ‘আমার সহোদর মুগ্ধ গুলিবিদ্ধ হয়। তার কপালে গুলি ছোট গর্ত করে ডান কানের নিচে বড় গর্ত করে বেরিয়ে গিয়েছিল। নিহত হওয়ার আগেও মুগ্ধ বিস্কুট ও পানি দিয়ে আন্দোলনে সহযোগিতা করছিল। সে সবসময় রাজনীতির বিপক্ষে থাকলেও মানুষের অধিকারের পক্ষে ছিল।’

১৮ জুলাই আন্দোলনে একসঙ্গে ছিলেন মুগ্ধ, তার বন্ধু জাকিরুল ইসলাম ও নাইমুর রহমান আশিক।

বন্ধুর মুগ্ধর মৃত্যুর বর্ণনা দিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমকে জাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘মুগ্ধর কপালে গুলি লেগে সেটি কানের পাশ দিয়ে গুলিটা বের হয়ে গেছে...ঘটনাস্থলেই আমাদের চোখের সামনে মারা গিয়েছে।’

মুগ্ধর রক্তে ভেসে যাওয়া সেই রাস্তার ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করে মুগ্ধ নাইমুর রহমান ফেসবুকে লিখেন, ‘মুগ্ধ ও জাকির আন্দোলনের মাঝেই একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য রোড ডিভাইডারের ওপর বসেছিলেন। হঠাৎ সবাই আমির কমপ্লেক্স আর রাজউক কমার্শিয়ালের ওইদিক থেকে দৌড়ে আসছে! আমরা দেখলাম! কিছুটা ধীর গতিতে উঠব ভাবলাম! দুই-তিন সেকেন্ড পর মুগ্ধর পায়ের ওপরে হাত রেখে বললাম, চল দৌড় দেই। আমার বন্ধু শেষবারের মতো আমাকে বললো চল ‘

‘প্রথমে জাকির উঠে দৌড় দিলেন এবং তারপর আমি। তিন থেকে চার কদম যাওয়ার পর আমার সামনেই জাকিরকে দেখছি দৌড়াচ্ছে। কিন্তু আমার পাশে মুগ্ধ নেই! থেমে গেলাম, পেছন ঘুরে তাকাতেই দেখি আমার বন্ধু ওই বসা অবস্থা থেকেই মাটিতে পড়ছে, চোখ দুটো বড় করে আমার দিকে তাকায় আছে, হাতে সেই অবশিষ্ট বিস্কুট আর পানির বোতলের পলিথিন, কপালে গুলির স্পষ্ট চিহ্ন। আমি চিৎকার করলাম—জাকির, মুগ্ধ গুলি খাইসে!’

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন

Loading...


© All Rights Reserved 2016-2025 | RTV Online | It is illegal to use contents, pictures, and videos of this website without authority's permission