রাজবাড়ীতে বিএডিসির পেঁয়াজ বীজে কৃষকের আশা ভঙ্গ
গত নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)-এর কাছ থেকে পেঁয়াজ বীজ সংগ্রহ করে হালি পেঁয়াজ আবাদের জন্য রাজবাড়ী জেলার চার হাজার কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করে কৃষি বিভাগ। ওই বীজে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে বীজ গ্রহীতাদের। কেননা, চার হাজার কৃষকের কারও জমিতেই বীজ থেকে চারা গজায়নি। বিষয়টি নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ ভুক্তভোগীরা।
সরেজমিনে রাজবাড়ীর কালুখালি উপজেলার রতনদিয়া ইউনিয়নের বলভপুর ও বহরকালুখালি গ্রামে এবং বালিয়াকান্দি উপজেলার বহরপুর ইউনিয়নের বারুগ্রাম এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সরকারিভাবে পাওয়া বীজ সঠিক নিয়মে বপন করা হলেও কারও খেতে একটি বীজও গজায়নি। অথচ যেসব খেত মালিক নিজে বাইরে থেকে বীজ কিনে বপন করেন তাদের বীজ ঠিকই গজিয়েছে।
এ সময় স্থানীয় কৃষক রহমান মণ্ডল ও লতিফ মল্লিক জানান, স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে কৃষি বিভাগ থেকে এক কেজি পেঁয়াজ বীজ পেয়ে তা বপন করেন তিনি। কিন্তু তিন সপ্তাহ পার হলেও একটি বীজও গজায়নি। আবার এ চারা থেকে পেঁয়াজ উৎপাদন করার জন্য ৫০ হাজার টাকা দিয়ে দুই বিঘা জমি লিজ নেন তিনি। সেই জমিও পড়ে আছে।
একই এলাকার কৃষক আফজাল খান বলেন, নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বালিয়াকান্দি কৃষি অফিস থেকে বিনামূল্যে পেঁয়াজের বীজ সরবরাহ করা হয়। সাধারণত রোপণের এক সপ্তাহের মধ্যে পেঁয়াজের বীজ থেকে চারা গজায়। কিন্তু এ বছর ২০ দিন অতিবাহিত হলেও বীজের অঙ্কুরোদগম হয়নি। যারা সরকারি বীজ পেয়েছেন সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এখন বীজের সংকটের কারণে অনেক জমিতে আর পেঁয়াজ রোপণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
বালিয়াকান্দির কৃষক হরিলাল পাল বলেন, পেঁয়াজ আমাদের এ এলাকার মানুষের প্রধান ফসল। এ পেঁয়াজ থেকেই আমরা আয় করি আবার সেখান থেকে আয় হওয়া অর্থ দিয়ে সংসার চালাই, এ বছর যে কপালে কী আছে তা কেউ জানে না। সাংবাদিক ও কৃষি কর্মকর্তারা আসছেন, ছবি তুলছেন, শুনছেন, তারপর চলে যাচ্ছেন। কিন্তু কোনো সমাধান নেই। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে আমরা আর পেঁয়াজ রোপণ করব না। এতে দেশে পেঁয়াজের আরও ঘাটতি দেখা দেবে।
এদিকে, খবরটি পুরো জেলায় ছড়িয়ে পড়লে মাঠ পরিদর্শন করেছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা। দ্রুত সময়ের মধ্যে কৃষকদের ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে আবার পেঁয়াজ বীজ বপন করা যায়, তা নিয়ে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে গত সোমবার জেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিএডিসির এমন কর্মকাণ্ডকে দায়িত্ব পালনে গাফিলতি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মো জাহিদুল ইসলাম মিঞাসক কমিটির বেশিরভাগ সদস্য।
রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, বিএডিসি কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই এ বীজ কৃষি বিভাগকে প্রদান করল যা কাজে গাফিলতির শামিল। বিষয়টি নিয়ে সভা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বিএডিসিকে বলা হয়েছে তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য।
রাজবাড়ী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, পেঁয়াজ উৎপাদনে সারা দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছে রাজবাড়ী। আবার সারা দেশের উৎপাদিত পেঁয়াজের শতকরা ১৪ ভাগ জোগান দেয় এই জেলা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এ জেলার পাঁচ উপজেলায় রবি প্রণোদনা হিসাবে চার হাজার কৃষকের মাঝে পেঁয়াজের বীজ বিতরণ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। এর অংশ হিসেবে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রাজবাড়ী সদর, গোয়ালন্দ, পাংশা, বালিয়াকান্দি ও কালুখালী উপজেলার চার হাজার কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে পেঁয়াজের বীজ বিতরণ করা হয়। বিএডিসির সরবরাহ করা পেঁয়াজ বীজ কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করে কৃষি বিভাগ। এর মধ্যে জেলার সদর উপজেলায় ৮০০ জন, পাংশায় এক হাজার, কালুখালীতে ৮০০, বালিয়াকান্দিতে এক হাজার এবং গোয়ালন্দ উপজেলায় ৪০০ কৃষক পান বিনামূল্যের বীজ। বিএডিসিকে বীজ বাবদ এক কোটি আট লাখ টাকা পরিশোধ করে কৃষি বিভাগ।
এ ব্যাপারে জেলা বীজ প্রত্যয়ন কর্মকর্তা মো. মাছিদুর রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নেমে ৩০ থেকে ৩৫টি স্পটে গিয়েছি। তাতে দেখেছি বারি পেঁয়াজ ফোর শতকরা তিন থেকে চার ভাগ গজিয়েছে, যা খুবই হতাশাজনক। আবার তাহেরপুরী চার থেকে পাঁচ ভাগ গজিয়েছে। এটা কারও কাঙ্ক্ষিত বা কাম্য নয়। পেঁয়াজ উৎপাদনে রাজবাড়ী একটি প্রতিষ্ঠিত জেলা। সেখানকার কৃষকদের এই ক্ষতি পুষিয়ে দিতে আমরা সুপারিশ করেছি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, পেঁয়াজ রোপণের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা মোটেও সন্তোষজনক নয়। আমরা বিএসডিসিকে পরামর্শ দিয়েছি কৃষকের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য।
তিনি বলেন, এ বছর রাজবাড়ী জেলায় ৩৬ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। বীজের এ ক্ষতির কারণে নির্দিষ্ট সময়ে হালি পেঁয়াজ বাজারে আসবে না।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) রাজবাড়ীর উপপরিচালক সৈয়দ কামরুল হক বলেন, কৃষক ও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্যাম্পল সংগ্রহ করে ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হবে। সরকারিভাবে পেঁয়াজ বীজের এমন দুর্দশায় উৎপাদন ব্যাহত হবে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এতে উৎপাদন ব্যাহত হবে না। বীজতলা নষ্ট হয়েছে, খেত তো নষ্ট হয়নি। কৃষক অন্য জেলা থেকে বীজ কিনে আবার রোপণ করতে পারবে।
আরটিভি/এএএ
মন্তব্য করুন