আন্তর্জাতিক মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করা এবং নৈতিক গুণে সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০০১ সালে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (এমআইইউ) যাত্রা শুরু করে। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলীসম্পন্ন করে গড়ে তোলা। মানারাতের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরা সমগ্র মুসলিম উম্মাহর একটি কাঙ্ক্ষিত আকাঙ্ক্ষা পূরণের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্ন পূরণের যাত্রার ২৫ বছর চলছে এ বছর। এ ২৫ বছরের যাত্রায় মানারাত তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্ধেকও অর্জন করেছে—এমন দাবি হয়তো এখনও কেউ করতে পারবেন না। তবে এ লেখার উদ্দেশ্য বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কী আছে, কী নেই সে কিংবা কতটুকু লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে, হয়নি সেসবের সমালোচনা বা চুলচেরা বিশ্লেষণ নয়; বরং আগামী ১০০ কিংবা তার বেশি বছরের পরিকল্পনায় মানারাত কীভাবে তার ভিশন অর্জন করতে পারে সে বিষয়ে।
‘মানারাত’ শব্দের ইংরেজি এবং বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে যথাক্রমে লাইটহাউজ এবং বাতিঘর। লাইটহাউজ হলো এমন একটি উঁচু টাওয়ার বা কাঠামো যা সমুদ্র বা অন্যান্য জলপথের নাবিকদের জন্য পথ নির্দেশ করে এবং পথ দেখিয়ে তাদেরকে গন্তব্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে। মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উদ্যেক্তারাও এমন চিন্তাভাবনা থেকেই প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করেছেন ‘মানারাত’। মানারাত নামকরণের সার্থকতা পাওয়া যায় এর স্লোগান নির্ধারণের মধ্যেও। ‘A Center of Academic and Moral Excellence.’ অর্থাৎ এ প্রতিষ্ঠান শুধু পাঠদানই করবে না; সেই পাঠ এবং পাঠকদের নৈতিকতার আলোয় উদ্ভাসিত করে তাদেরকে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে দেবে।
মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি একটি আইডিওলজিক্যাল প্রতিষ্ঠান। মিশরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়া (আইআইইউএম) যেমন ঠিক তেমন। চোখ ধাঁধানো সভ্যতা, বুর্জোয়া ভোগবাদী সংস্কৃতির বিপরীতে কাউন্টার একটি সভ্যতা, আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে অবশ্যই সে ধরনের প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে হবে। একটি আদর্শিক প্রতিষ্ঠানের অবয়ব, গঠন, আকার, প্রোগ্রাম প্রভৃতি কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে ধারণা পাওয়ার জন্য নিচে উল্লিখিত বিশ্ববিদ্যালয় দুটির সংক্ষিপ্ত পরিচতি তুলে ধরা হলো।
আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি মিশরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে খুবই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। বিশ্ববিদ্যালয়টি ৯৭০ বা ৯৭২ সালে কায়রোয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে ইসলামিক আইন, যুক্তি, ব্যাকরণ ও অলঙ্কার শাস্ত্রে পাঠদান করা হয়। তবে, এর লক্ষণীয় দিক হচ্ছে, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় আরব বিশ্বের অন্যতম আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে টিকে আছে। আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং উচ্চতর ডিগ্রি প্রোগ্রাম পরিচালনা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রয়েছে ৮১টি অনুষদ, ৯টি ইনস্টিটিউট, ৩৫৯টি একাডেমিক বিভাগ, ৪২টি সেন্টার, ৬টি বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল এবং ২৭টি সাধারণ প্রশাসনিক বিভাগ। আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল বিষয়ভিত্তিক ক্ষেত্রগুলো হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, ব্যবস্থাপনা ও ব্যবসা প্রশাসন, শিল্পকলা, ভাষা ও মানবিক শাস্ত্র, কৃষি, দন্তচিকিৎসা এবং চিকিৎসাবিজ্ঞান।
ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়া
ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়া (আইআইইউএম) ১৯৮৩ সালের ২৩ মে প্রতিষ্ঠিত একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এর প্রধান ক্যাম্পাসের আয়তন প্রায় ৭০০ একর (২.৮ বর্গকিলোমিটার)। এ ছাড়াও আইআইইউএম-এর আরও ছয়টি ক্যাম্পাস রয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে মোট ১৪টি অনুষদ এবং ৪টি মূল গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ও কেন্দ্র রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষার্থীদের জন্য বহুবিধ প্রোগ্রাম চালু করেছে। অনেকগুলো স্বল্পমেয়াদী সার্টিফিকেট প্রোগ্রাম যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ২০টিরও বেশি ডিপ্লোমা প্রোগ্রাম। স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি পর্যায়ে আইআইইউএম বহু বিষয়ভিত্তিক প্রোগ্রাম পরিচালনা করে থাকে। বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী এবং ১ হাজার ৯০০ জন শিক্ষক রয়েছেন। এর মধ্যে ৬ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশের।
আমি চাই মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের বর্তমান সদস্যরা একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করবেন। বাংলাদেশ এবং বিশ্বব্যাপী ‘মানারাত ইফেক্ট’ তৈরি হবে—এমন উদ্যোগ নেবেন। কার্যকর অর্থেই আলোকবর্তিকা হওয়ার জন্য যত ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার নেবেন। দেশ-বিদেশের মেধারী শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যকে এখানে ভর্তি হবেন। ২০ কোটি জনসংখ্যার দেশে অন্তত ২০ হাজার শিক্ষার্থী নিয়মিতভাবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবেন।
এসব লক্ষ্য অর্জনে অন্তত ১০০ বছরের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ঢাকা সিটির বাইরে কোলাহলমুক্ত সবুজ পরিবেশে ন্যূনতম ১০০ থেকে ২০০ একর কিংবা তারও অধিক জায়গা নিয়ে অনিন্দ্যসুন্দর ক্যাম্পাস করতে হবে। এখানে ছেলে এবং মেয়েদের জন্য পৃথক ক্যাম্পাস থাকবে। শিক্ষার্থীদের আবাসন সমস্যা দূর করার জন্য পর্যাপ্ত আবাসন ব্যবস্থা থাকবে। ঢাকা শহর এবং আশেপাশের জেলাগুলোর মধ্যে যাতায়াতের জন্য পরিবহনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকবে।
১০ থেকে ১৫টি অনুষদ, সমানসংখ্যক ইনস্টিটিউট এবং সেন্টার, গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আইডিওলজিক্যাল এবং বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি পর্যায়ে যতবেশি সম্ভব প্রোগ্রাম পরিচালনা করতে হবে। বাস্তবতার আলোকে উন্নতমানের বেতন কাঠামো নির্ধারণ করতে হবে। শিক্ষা, প্রযুক্তি এবং নৈতিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। তাহলেই কেবল মানারাত প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তাদের সম্মানিত করা হবে এবং সত্যিকারের ‘মানারাত ইফেক্ট’ তৈরি হবে। চীন দেশে একটি প্রবাদ আছে, ‘তুমি যদি এক বছরের পরিকল্পনা করো তাহলে শস্য রোপণ কর, তুমি যদি দশ বছরের পরিকল্পনা করো তাহলে গাছ লাগাও, আর যদি হাজার বছরের পরিকল্পনা করে থাক তাহলে মানুষ তৈরি কর।’ মানুষ তৈরির কারখানা হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি