পাতা ঝরার দিন শেষ হয়েছে। পত্রপল্লব জেগে উঠে গাছে গাছে নতুন করে সঞ্চার হয়েছে জাগরণ। পাতায় পাতায় নতুন রং লেগে পাখি, প্রজাপতি আর সৌন্দর্য পিপাসু পতঙ্গদের ডেকে বলছে, আয় আমার এখানে আয়। সেই আহবানে সাড়া দিয়ে বসন্তের পাখি ও পতঙ্গরা ভিড় করেছে গাছের পাতায় পাতায়, ফুলে ফলে। শীতের প্রকোপ শেষে নরম প্রকৃতিতে কোমল বাতাস বইতে শুরু করেছে। মনে তারুণ্যের বয়ে আনা প্রকৃতির এই বর্ণিল ও কোমল আয়োজন তরুণ প্রাণে বইতে শুরু করেছে। মেয়েরা খোপায় গাদা ফুল ও বাসন্তী রংয়ের শাড়ি আর ছেলেরা বাহারি রংয়ের পাঞ্জাবি-পাজামা কিংবা ফতুয়া পড়ে বেড়িয়ে পড়েছে; কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে আর ঠোটে এই গান গুনগুণ করে। ও হ্যাঁ, বসন্ত এসে গেছে। আজ ১ ফাল্গুন, ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিন। এ কারণেই মনে আর প্রকৃতিতে আজ এতো আয়োজন।
বাতাসে বহিছে প্রেম,
নয়নে লাগিলো নেশা
কারা যে ডাকিলো পিছে,
বসন্ত এসে গেছে
মধুর অমৃতবানী বেলা গেল সহজেই
মরমে উঠিল বাজি বসন্ত এসে গেছে
থাক তব ভুবনের ধুলি মাখা চরনে
মাথা নত করে রব...
বসন্ত এসে গেছে, বসন্ত এসে গেছে।
কলকাতার জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ও গীতিকার অনুপম রয়ের গানের এই ক’লাইন বলে দেয় বসন্ত প্রাণে প্রাণে কেমন সাড়া জাগিয়েছে, জাগায়। প্রচণ্ড গরম শেষে থর থর কাঁপনের শীত যখন চলে যায় তখন মনে-প্রাণে নতুন তারুণ্য চোখে নেশা ধরায়, তাই শিল্পী অনুপম বলে গেছেন।
ফাল্গুনের প্রথম দিন মানে নতুন দিনের সূচনা। শীতের দাপট শেষে নরোম রোদ আর প্রকৃতির বাহারি সাজ মনে করিয়ে দেয়। শীতের শেষের কয়েকদিন আগে থেকে বসন্তের পাখি ডাক দিয়ে যায়। ডাক দিয়ে যায় তরুণ-তরুণীকে। ডেকে ডেকে বলে যায় বেড়িয়ে পড়ো বাসন্তী সাজে যেখানে প্রেম আ প্রকৃতি এক হয়ে মিশে গেছে।
আহা, আজি এ বসন্তে
এত ফুল ফুটে
এত বাঁশি বাজে
এত পাখি গায়
আহা, আজি এ বসন্তে...
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের কথায় প্রকৃতিতে বসন্তের আবেদন প্রাণে সঞ্চার করে নতুন আশা। বাঙালির জীবনে বসন্তের উপস্থিতি আর আয়োজন সেই অনাদিকাল থেকেই। সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনেও বসন্ত ঠাঁই করে নিয়েছে স্বমহিমায়। আর শহুরে বসন্তেও যেন সেই আত্মীয়তা থাকে। কানে কানে বলে যায়, আজ ভুলিয়ো আপন পর ভুলিয়ো। ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’।
বসন্ত মানেই পূর্ণতা। বসন্ত মানেই প্রাণচঞ্চলতা। কচিপাতায় আলোর নাচন। বাঙালি জীবনে বসন্ত আর আন্দোলন যেন মিলেমিশে একাকার। বসন্তের আগমন বার্তা ১৯৫২ সালের সেই ফাল্গুন মনে করিয়ে দেয় যেদিন পিচঢালা রাজপথে লাল ফুল হয়ে ভাষা শহীদেরা নিহত হয়েছিলেন শাসকের গুলিতে। বসন্তেই বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পথে নেমেছিল। বসন্ত মনে করিয়ে দিয়ে যায় এ প্রজন্ম ২০১৩ সালে জেগে উঠেছিল ফাগুনে গণজাগরণে। তাই কেবল প্রকৃতি আর মনে নয়,বাঙালির জাতীয় ইতিহাসেও বসন্ত আসে বারবার।
গত দুই বসন্ত ছিল এদেশের মানুষের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়, ছিল করোনা অতিমারীর সময়। কিন্তু এবার, সেই বসন্ত মানেই যেখানে নতুন প্রাণের কলরব, সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা অনেকটায় ম্লান করে দিয়েছিল। এবার অন্যরকম বসন্ত উদযাপনের অপেক্ষায় আছে বাঙালি মন। বর্ণিল সাজে আর ফুলের বর্ণচ্ছটা গায়ে মাখিয়ে তরুণ-তরুণীরা বইমেলা, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, চারুকলার বকুলতলা মাতাবে।