জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশের ৬টি টেলিভিশনের ইউটিউব চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ভারতের ইউটিউব কর্তৃপক্ষ জিও ব্লক করায় যমুনা, একাত্তর, ডিবিসি, সময়, বাংলাভিশন ও মোহনা টিভির ইউটিউব চ্যানেল ভারতীয় ভূ-খণ্ড থেকে দেখা যাচ্ছে না। দেশটির তথ্যপ্রযুক্তি আইন-২০০০’এর ৬৯’এর (ক) ধারার ক্ষমতা বলে জাতীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব কিংবা জনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি সৃষ্টি করে কিংবা করতে পারে, এমন যেকোনো ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক পেজ, আইডি কিংবা অনুরূপ ডিজিটাল প্লাটফর্ম যেকোনো মুহূর্তে ভারত সরকার বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু দেশটির সরকার বাংলাদেশি যেসব টেলিভিশনের ইউটিউব চ্যানেল বন্ধ করেছে, সেগুলোর কনটেন্ট কোনোভাবেই ভারতের প্রচলিত তথ্যপ্রযুক্তি আইন লঙ্ঘন করেনি। তার মানে এর মধ্য দিয়ে ভারত সরকার বাংলাদেশকে একটি স্পষ্ট বার্তা দিতে চেয়েছে যে, তারা ডিজিটাল প্লাটফর্মেও যা খুশি তা করতে পারে। শুধু যে ইউটিউব চ্যানেল বন্ধের ক্ষেত্রেই ভারত চরম স্বেচ্ছাচারিতা করেছে তা নয়, দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের সব ধরনের টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ করে রেখেছে দেশটি। অথচ, শতাধিক ভারতীয় টিভি চ্যানেল বাংলাদেশে অবাধে সম্প্রচার হয়ে আসছে।
‘কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন-২০০৬’ নামে বাংলাদেশেও একটি আইন আছে। কিন্তু প্রয়োগ নেই। ‘অনেকটাই কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’—এর মতো অবস্থা। দেশি কিংবা বিদেশি একটি টেলিভিশন চ্যানেল কোন কোন শর্ত পরিপালন সাপেক্ষে বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে সম্প্রচার হতে পারবে, কিংবা কোন কোন শর্ত লঙ্ঘন করলে সম্প্রচার স্থগিত বা স্থায়ী বন্ধ করে দেওয়া হবে, তার বিস্তারিত উল্লেখ আছে ঠুটো জগন্নাথ এই আইনের ১৯ ধারায়। ঠুটো জগন্নাথ বলার কারণ প্রতিবেশী ভারত এই ১৯ ধারার ১৪টি উপধারার বেশিরভাগই ক্রমাগত লঙ্ঘন করে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত ভারতীয় টেলিভিশন সম্প্রচার বন্ধে শক্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
রিপাবলিক বাংলার মতো ভারতীয় গদি টিভি ও ইউটিউব চ্যানেলগুলো বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে সেদেশে ক্রমাগত ঘৃণার চাষাবাদ করে চলেছে। যেহেতু বাংলাদেশি কোনো টিভি চ্যানেল ভারতে সম্প্রচার হয় না, ফলে সেসব চ্যানেল বাংলাদেশ সম্পর্কে মনগড়া অসত্য তথ্য দিয়ে যে ন্যারেটিভ তুলে ধরে তাই বিশ্বাস করতে বাধ্য হন সেদেশের সাধারণ মানুষ। এতে দুই দেশের মানুষের মাঝে দুরত্ব যেমন বাড়ছে, তেমনি প্রতিবেশী দেশটির নীতি-নির্ধারকরাও বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেকক্ষেত্রেই থাকছেন অন্ধকারে। যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ভারতের সরকার ও জনগণের আচরণে। শুধু তাই নয়, টেলিভিশন চ্যানেলের অবাধ সম্প্রচারের সুযোগ নিয়ে এক টাকা বিনিয়োগ না করেও বাংলাদেশে নিজেদের পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করে চলেছে ভারত। ফুলকি, কথা, পরিণীতার মতো অগণিত ডেইলি সোপের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভোক্তাদের মগজে ঢুকে পড়ছে ভারতীয় পণ্য। কাপড়, প্রসাধনী, গৃহস্থালি পণ্যের ক্ষেত্রে ভারতীয় ব্যান্ডের কদর বাড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো। এতে শুধু যে নিজেদের পণ্যের বাজার বেহাত হচ্ছে তা নয়, নিজেদের সংস্কৃতিও পড়েছে বড় ঝুঁকিতে। আজকাল বিয়েশাদির আয়োজনে বাংলাদেশী সংস্কৃতির জায়গা দখল করে নিয়েছে ভারতীয় সংস্কৃতি। মনে রাখা দরকার, নব্য উপনিবেশবাদের যে ধারণা, তার বড় অংশ জুড়েই রয়েছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও আধিপত্য।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের। জনআকাঙ্ক্ষা ও জনদাবির মুখে, গণহত্যা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ে সন্ত্রাস বিরোধী আইনের আওতায় গত ১০ মে, ২০২৫ বিচার না হওয়া পর্যন্ত দলটির সব ধরনের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রজ্ঞাপন জারির পর, নিবন্ধন স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন। পতনের আগে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে যেমন পঙ্গু করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ, তেমনি ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলের অবাধ সম্প্রচারের সুযোগ দিয়ে সাংস্কৃতিকভাবেও পরনির্ভরশীল করে দিয়েছে দলটি।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নতুন যে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হলো, সেইদেশের নতুন নীতি-নির্ধারকরাও কেন ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ব্যাপারে এতোটা উদাসীন? ভারত বাংলাদেশের ৬টি টেলিভিশন চ্যানেলের ইউটিউব চ্যানেল বন্ধ করেছে। বাংলাদেশ কেন রি-পাবলিক বাংলার মতো চ্যানেলগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে না? ফুটপাতে মলম বিক্রির মতো চিৎকার-চেঁচামেচি আর কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে এই চ্যানেলটি শুধু তো নিজ দেশে ঘৃণার ব্যবসা করছে না, বাংলাদেশের মানুষের মনকেও বিষাক্ত করে তুলছে। ক্রমাগত প্রপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। ভারত যদি তাদের দেশে বাংলাদেশি টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ করে রাখার ক্ষেত্রে অনড় থাকতে পারে, তবে আমরা কেন এখনো অবারিত করে রেখেছি? বাংলাদেশ সরকারের এমন নতজানু নীতি কি জুলাই বিপ্লবের স্প্রিটের পরিপন্থি নয়? ১৪’শ মানুষ প্রাণ দিয়েছেন, ২০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন, অনেকেই সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করে নিয়েছেন। তাদের এই বিপুল ত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে হলেও দ্রুত ভারতীয় টিভি চ্যানেল সম্প্রচারের ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থান নেয়া দরকার।
প্রথমত বাংলাদেশি টিভি চ্যানেলগুলো সম্প্রচারের ক্ষেত্রে যে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, তা দূর করতে হবে। বাংলাদেশে যত সংখ্যক ভারতীয় টিভি চ্যানেল সম্প্রচার হয়, সমসংখ্যক বাংলাদেশি টিভি চ্যানেলও ভারতে সম্প্রচার করার সুযোগ থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভারতের তরফে ট্যারিফ–ননট্যারিফ যে কৌশলী শর্ত আরোপ করা আছে, তা তুলে নিতে হবে, অথবা একই রকম শর্ত বাংলাদেশেও ভারতীয় চ্যানেল সম্প্রচারের ক্ষেত্রে আরোপ করতে হবে। ভারতীয় আধিপত্যবাদ, মিডিয়ার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং মাফিয়াগিরি ঠেকাতে এমন উদ্যোগ নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। এখন না হলে, আর কখনই সম্ভব হবে না।
লেখক: কলামিস্ট ও আরটিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
আরটিভি/একে/এআর