রাবি’র বধ্যভূমিতে এখনো শোনা যায় কান্না

আমির ফয়সাল ও শহিদুল ইসলাম শহীদ, রাজশাহী

বুধবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬ , ১১:১৫ এএম


রাবি’র বধ্যভূমিতে এখনো শোনা যায় কান্না

রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়ক। তার পাশেই মতিহারের সবুজ চত্বর। যেখানে অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। হাজারো স্মৃতিকে বুকে নিয়ে ১৯৫৩ সাল থেকে দেশের উচ্চ শিক্ষায় অবদান রেখে আসছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধসহ বেশ কয়েকটি আন্দোলনে অবদান রেখেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক। শহীদ ড.শামসুজ্জোহা, শহীদ ড. সুখরঞ্জন সমাদ্দরের কথা যেন না বললেই নয়।

বিজ্ঞাপন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে একটু সামনে যেতেই চোখ পড়ে হাতের বাম পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাবাস বাংলাদেশ ভাস্কর্য। যেটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত একটি নিদর্শন। এরপর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, শেরে বাংলা ফজলুল হক হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল। তারই পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুটা সামনে গেলে দেখা যায় একটি আবাসিক হল। সেই উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে নিজ ছাত্রদের বাঁচাতে শহীদ হয়েছিলেন ড. শামসুজ্জোহা। আর তারই নামে গড়ে ওঠে এই  হলটি। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনী এই হলটিকে তাদের মিনি ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করে।

হলটির পাশ দিয়ে আর একটু হেটে পূর্বদিকে গেলেই দেখতে পাওয়া যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমি। ইট-সুরকি দিয়ে নির্মিত এই স্তম্ভ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ঘাতক পাক বাহিনীর হাতে যারা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন সেইসব মৃত্যুহীন শহীদ এই গণকবরে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।  ১৯৯৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর এই স্মৃতিফলকটি উন্মোচন করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর সাইদুর রহমান খান।

বিজ্ঞাপন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন মিশ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বধ্যভূমি সম্পর্কে বলেন, জোহা হলে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজশাহীসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকা যেমন নাটোর, বগুড়া, পাবনা নওগাঁ এবং রংপুর থেকে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে ধরে নিয়ে এসে পাশবিক নির্যাতনের পর নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

তিনি আরো বলেন, অসংখ্য মা-বোনকে এখানে নিয়ে এসে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এ বধ্যভূমিতে কঙ্কাল এবং স্বর্ণালংকারসহ অনেক কিছু পাওয়া গেছে। জোহা হল সংলগ্ন প্রায় ১ বর্গ কিলোমিটার বিশাল এলাকা জুড়ে সে সময়ে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। পাকিস্তানী সৈন্যরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমিতে প্রায় ৪ হাজার মানুষ হত্যা করেন। তারই স্মৃতিকে ধারণ করতে এখানে তৈরি করা হয় স্তম্ভটি।

এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদ ড. শামসুজ্জোহা, শহীদ ড. সুখরঞ্জন সমাদ্দার, মীর আব্দুল কাইয়ুম সহ আরও অগনীত বুদ্ধিজীবীকে রাজশাহীসহ বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময় নির্মমভাবে হত্যা করে পাকসেনা ও তাদের দোসররা।

বিজ্ঞাপন

বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভটি সমতল ভূমি থেকে কংক্রিটের বেদি তৈরি করা হয়েছে। বেদিটির ঠিক মাঝখানে কংক্রিটের বড় একটা কূপ। কূপের মাঝখানে দণ্ডায়মান ৪২ ফুট উঁচু এবং ৬ স্তম্ভবিশিষ্ট একটি স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে। স্তম্ভটির গায়ে রয়েছে কালো কালো দাগ, যেটা শহীদদের রক্ত শুকানো দাগের প্রতীক। অপর দিকে কূপটাকে মৃত্যু কূপের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এ বধ্যভূমি দেখলেই অনুভব করা যায় কি নির্মমতা ঘটেছিল সেসময়। আর এই করুণ উপলব্ধিটি মানুষকে বোঝানোর জন্যই এর রূপকার এমন রূপটি দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিভিন্ন দিবসে সেখানে পুষ্পস্তর্বক অর্পণ করে। তবে অনেকের দাবি স্মৃতিস্তম্ভটির একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস যদি ফলকের মাধ্যমে তুলে ধরা যেত তাহলে দর্শনার্থীরা খুব সহজেই এর গভীরতা বুঝতো।

বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণের জন্য উপাচার্য  প্রফেসর ড. আব্দুল খালেক ১৯৯৮ সালে সরকারের নিকট সুপারিশ করেন। স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের ব্যয় ধরা হয় আড়াই কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রথম স্তম্ভের নির্মাণ কাজে ব্যয় হয়েছে ৮৪ লক্ষ টাকা।

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে স্মরণীয় করে রাখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে ওঠেছে নানা স্মৃতিস্তম্ভ মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের ৩৭টি জেলায় ৩৬৪টি বধ্যভূমি সনাক্ত করা হয়। যার মধ্যে ১৩ টি বধ্যভূমিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। তারই একটা অংশ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বধ্যভূমি। ২০০২ সালের ২১ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী রেদোয়ান আহমেদ।

এসএস

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন

Loading...


© All Rights Reserved 2016-2025 | RTV Online | It is illegal to use contents, pictures, and videos of this website without authority's permission