থামছে না হাইব্রিড অনুপ্রবেশ, ওরাও এখন বিএনপি!
হাইব্রিড নেতাকর্মীদের দলে জায়গা না দিতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সে অনুযায়ী, অনুপ্রবেশকারী হাইব্রিড নেতাকর্মী ঠেকাতে ওয়ার্ড থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বিএনপির কমিটি গঠনে নেওয়া হচ্ছে বাড়তি সতর্কতা। কিন্তু তারপরও হাইব্রিড অনুপ্রেবশকারীদের ঠেকানো যাচ্ছে না। প্রতিদিনই ওয়ার্ড থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বিভিন্নস্তরে বিএনপিতে আবির্ভাব ঘটছে হাইব্রিড নেতাদের। আন্দোলনের মাঠে ছিলেন না, মামলা-হামলা কিংবা নির্যাতনের মুখেও ছিলেন না, ঘরছাড়াও হতে হয়নি।
বিগত দিনে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন, তাল মিলিয়ে চলেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে। তারাই এখন বনে গেছেন বিএনপির দাপুটে হর্তাকর্তা। এসব হাইব্রিড অনুপ্রবেশকারী নেতাদের সঙ্গে যোগ হয়েছেন নব্য বিএনপি নামধারী অনেকে। যারা কখনোই বিএনপিতে সম্পৃক্ত ছিলেন না, তারাই এখন নানা জায়গায় দখল-চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্ম করে বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলছেন। দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছেন। আবার হাইব্রিড অনুপ্রবেশকারীরাই এখন বিএনপির তৃণমূলের ত্যাগীদের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। ঢাকা মহানগর উত্তরের থানা খিলক্ষেত। এখানেও বিএনপিতে অনুপ্রবেশকারী হাইব্রিড নেতাদের ছড়াছড়ি। হাইব্রিড নেতাদের দাপটে কোণঠাসা ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা।
খিলক্ষেত থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সদস্য কেরামত আলী দেওয়ান, খিলক্ষেত থানার কথিত বিএনপি নেতা মোবারক হোসেন দেওয়ান (সম্পর্কে তারা চাচা ভাতিজা), মোবারক হোসেন দেওয়ানের আপন ভাই মোজাম্মেল হোসেন দেওয়ান খিলক্ষেত থানা আওয়ামী লীগের নেতা, দক্ষিণখান থানা ৪৮নং ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাবেক কমিশনার ও দক্ষিণখান ইউনিয়নের যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বুলবুল, খিলক্ষেত থানাধীন ৯৬নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী আমিন। এরা সকলেই বিগত দিনে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি হাবীব হাসানের ঘনিষ্ট ছিলেন। বিগত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের শাসনামলে তারা ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে বিত্তবান হয়েছেন। খিলক্ষেত থানায় ঘুরিয়েছেন ক্ষমতার ছড়ি। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পলায়নের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তারাই এখন বিএনপির হর্তাকর্তা সেজে গেছেন।
ঢাকাসহ সারাদেশে বিএনপির দলীয় কার্যালয়গুলো ছাড়াও বিভিন্ন সড়কের অলিগলিতে এখন হাইব্রিড অনুপ্রবেশকারী নেতাদের ব্যানার, পোস্টার শোভা পাচ্ছে। বিভিন্ন নেতার বাসাবাড়ি কিংবা অফিসে এসব নেতার পদচারণাও বাড়ছে। ভিড় করছেন বিভিন্ন লবিং-তদবির নিয়ে। অন্যদিকে, দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে যেসব নেতাকর্মী রাজপথে ছিলেন, মামলা-হামলায় সর্বস্বান্ত হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, ঘরছাড়া হয়েছেন, তারা এখন অসহায়। হাইব্রিড নেতাদের চাপে তাদের অনেকেই এখন দলীয় কার্যালয়, নেতাদের বাসাবাড়ি এড়িয়ে চলছেন। অহেতুক মিথ্যা অভিযোগে বহিষ্কার আতঙ্ক নিয়ে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন অনেকে।
ঢাকা মহানগর বিএনপিতেও চলছে অতিবিপ্লবী নেতাদের দাপট। বিগত দিনের আন্দোলনে কোথাও না থাকলে এখন হয়েছেন সবচেয়ে কট্টর নেতা। তারাই এখন বড় নেতা সেজেছেন। তারাই নিয়ন্ত্রণ করছেন বড় বড় প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদার, সরবরাহকারীর কার্যক্রম। কাকে কোন পদে বসাবেন, কাকে সরাবেন তাও তারা নিয়ন্ত্রণ করছেন। সেখানে বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে এলাকা ছাড়ার ঘটনাও ঘটছে।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ে বলছেন, বিএনপির সুদিনের সম্ভাবনায় এখন অনেক হাইব্রিড নেতা জুটতে শুরু করেছেন, আওয়ামী লীগের অনেক সুবিধাভোগী খোলস পরিবর্তন করে বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে চাচ্ছেন। এ বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে কঠোর নির্দেশনা থাকলেও বিভিন্ন কায়দা-কানুন করে দলের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে আখের গোছানোর চেষ্টা করছেন বলে তারা জানতে পারছেন। এসব নেতাকর্মীই দেশের বিভিন্ন জায়গায় অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন। চতুর প্রকৃতির হাইব্রিড নেতারা সুযোগ বুঝে সটকে পড়লেও ধরা খাচ্ছেন বিএনপির কতিপয় নেতাকর্মী। যাদের অপকর্মের দায়ে বহিষ্কার হতে হচ্ছে।
বিএনপিতে অনুপ্রবেশকারী হাইব্রিড নেতাদের দৌরাত্ম্য সর্ম্পকে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, হাইব্রিড নেতাদের বিষয়ে আমরা সতর্ক রয়েছি। এরই মধ্যে দল থেকে নেতাকর্মীকে সতর্ক করা হয়েছে। দলে যোগদান অনুষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। এরপরও বিভিন্ন জায়গায় বিএনপির নাম ভাঙিয়ে অনেকে অনেক অপকর্ম করছেন। যাদের সঙ্গে বিএনপির ন্যূনতম কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বিএনপির দুর্দিনে যারা ত্যাগ স্বীকার করেছেন, পরিশ্রম করেছেন দল তাদের মূল্যায়ন করবে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ বিষয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীকে বিভিন্ন সময়ে আশ্বস্ত করেছেন।
বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, ওয়ান-ইলেভেন থেকে শুরু করে আওয়ামী সরকারের আমলে সীমাহীন নির্যাতনের মধ্য দিয়ে দলের নেতাকর্মীরা রাজপথে থেকেছেন। অনেকে গুম হয়েছেন, অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। দলের এমন কোনো নেতাকর্মী নেই, যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। অনেকের বিরুদ্ধে মামলার তিন সেঞ্চুরিও পার হয়েছে বিগত দিনে। এসব মামলায় সর্বস্বান্ত হতে হয়েছে তাদের। অনেকের সহায়-সম্পদ দখল করা হয়েছে, অনেককে ঘরবাড়ি ছাড়া হতে হয়েছে।
তবে যেসব নেতাকর্মী আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করেছেন, তারা ছিলেন বহাল তবিয়তে। ওই সময়ে তারা নিজেদের মতো করে ব্যবসা করেছেন, নিরাপদে থেকেছেন। কোনো নির্যাতন তাদের স্পর্শ করতে পারেনি। তারা সবসময়ই বিভিন্ন লবিং-তদবিরে পদ বাগিয়েছেন। আর এখন দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারাই দলের সামনের সারিতে চলে এসেছেন।
এটা শুধু বিএনপির নেতাকর্মীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। দল-সমর্থিত বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের মধ্যেও বিস্তার করেছে। সাংবাদিক, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, শিক্ষক থেকে শুরু করে অন্যান্য পেশার মধ্যেও দৌরাত্ম্য বেড়েছে বিগত দিনের নিষ্ক্রিয়দের। এমন অবস্থা অব্যাহত থাকলে একসময় পুরো দলকে এর চরম খেসারত দিতে হবে বলে শঙ্কিত বিএনপির নেতারা।
আরটিভি/এসএইচএম
মন্তব্য করুন