নওগাঁর রাণীনগরে জমির মালিকানা বিরোধের জেরে চারটি পরিবারকে সাত মাস ধরে এক ঘরে করে রাখার অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া ইটের প্রাচীর দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে চার পরিবারের চলাচলের রাস্তা। এ ঘটনার সুষ্ঠু প্রতিকার চেয়ে লিখিত অভিযোগ করেও প্রতিকার মেলেনি ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর।
এরইমধ্যে গত শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে অভিযুক্তরা ভুক্তভোগী রমজান ও কালামকে বেদম মারপিট করে। পরে গুরুত্বর আহত অবস্থায় রমজানকে প্রথমে নওগাঁ সদর হাসপাতালে ভর্তি করে পরিবারের সদস্যরা। রমজানের অবস্থা গুরুত্বর হলে রোববার (৬ ফেব্রুয়ারি) রাতে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঘটনাটি ঘটেছে উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের বড়খোল গ্রামে।
ভুক্তভোগী পরিবার সূত্রে জানা যায়, বড়খোল উচ্চ বিদ্যালয়ের জমি নিয়ে ছামছুর দেওয়ানসহ ৪ পরিবারের জায়গার মালিকানা নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। গ্রামের মাতব্বর প্রধান এবং ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন জায়গা ছেড়ে দিয়ে ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে পার্শ্বে খাস জমিতে বসতি স্থাপনের প্রস্তাব দেয়। স্কুল কমিটি ও মাব্বরদের দাবি ওই চার পরিবারের যৌথ মালিকানার জায়গার মধ্যে স্কুলের কিছু অংশ আছে। জায়গা ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব নাকচ করার কারণে গত সাত মাস আগে গ্রামের মাতব্বর আব্দুল করিম, রিয়াজুল ইসলাম, বেলাল ও প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেনসহ লোকজন নিয়ে ছামছুর দেওয়ানের পরিবারের সদস্য মোমেনা বিবির ঢোক দোকান ঘর ভেঙে দেয়। এরপর মাতাব্বররা ছামছুর দেওয়ান, ভাই উজ্জল দেওয়ান, শরিকান রমজান দেওয়ান এবং মোমেনা বিবিসহ চার পরিবারকে এক ঘরে করে রাখে। এরপর জায়গার মালিকানা নিয়ে আদালতে মামলা করা হয়।
ছামছুর দেওয়ান জানান, মাতব্বর রিয়াজ দেওয়ান নিজে এসে আমাদের চার পরিবারের লোকজনকে এক ঘরে করে রাখার বিষয়টি জানায়। এছাড়া সমাজের কোন লোকজন চার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেনা। আমার ভ্যান গাড়িতে যাতায়াত করতে ও দোকান থেকে কোন জিনিস ক্রয় করতে এবং মসজিদে নামাজ পরতে পারবেনা বলে জানিয়ে দেয়।
তিনি আরও জানান, নির্দেশনা ভঙ্গ করলে তার এক হাজার টাকা জরিমানা করা হবে বলেও তারা ঘোষণা দেয়। এমন নির্দেশনার পর থেকে গ্রামের কোন লোকজন আমাদের সঙ্গে কথা বলেনা। দোকান থেকে কোন জিনিসপত্র নেয় না এবং ভ্যান গাড়িতেও কেউ যাতায়াত করে না। এছাড়া আমাদের পৈত্রিক জায়গাকে বিদ্যালয়ের জায়গা দাবি করে আমাদের চার পরিবারের লোকজনের চলা-চলের রাস্তা ইটের প্রাচীর দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে করে বাড়ি থেকে বের হতে হচ্ছে প্রাচীর টপকে। ফলে ২১ জন সদস্য নিয়ে চরম দূর্ভোগে পড়েছি চার পরিবার।
ওই গ্রামের ইকবাল হোসেন, খায়রুল ইসলাম প্রামাণিকসহ কয়েকজন জানান, স্কুলের সঙ্গে জায়গা নিয়ে বিরোধ চলছে। কয়েকবার বসেও সমাধান হয়নি। তাই মাতব্বরদের নির্দেশে সমাজ থেকে তাদেরকে এক ঘরে করে রেখেছে। যে কারণে আমরাও কথা বলি না। ওই চার পরিবার একই বংশের। স্কুল কমিটির দাবি ওই চার পরিবারের জায়গার মধ্যে স্কুলের কিছু অংশ আছে। এর বেশি কিছু বলতে পারছি না আমরা।
এ ঘটনার সুষ্ঠু প্রতিকার চেয়ে ছামছুর দেওয়ান নওগাঁ জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ করলে গত ২৭ অক্টোবর জেলা প্রশাসক রাণীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ‘ব্যক্তিগতভাবে দেখে অবহিত’ করার নির্দেশ দেন। এরপর নির্বাহী কর্মকর্তা ঘটনাস্থল তদন্ত করে আসলে এখন পর্যন্ত কোন সুষ্ঠু প্রতিকার মেলেনি বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
গ্রামের প্রধান মাতব্বর ও স্কুলের আব্দুল করিম এক ঘরে করে রাখার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ছামছুর দেওয়ানরা খারাপ মানুষ। যে কারণে গ্রামের কোন লোকজন ঘৃণা করে ওদের সঙ্গে কথা বলে না। এছাড়া ওরা নিজেরায় নিজেদের চলাচলের রাস্তা বন্ধ করেছে। আমরা তাদেরকে বন্ধ করিনি।
অভিযোগ উঠছে ওই চার পরিবারের জায়গার মধ্যে স্কুলের জায়গা আছে। সেই দাবির প্রেক্ষিতে জায়গা মালিকানা ছেড়ে না দেওয়ার কারণে এক ঘরে করে রেখেছেন আপনারা। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কিছু বলতে চাইনা। আপনি দেখা করুন বলেই ফোন কেটে দেয়।
বড়খোল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন বলেন, স্কুলের জায়গা কিছু জায়গা ওই চারটি পরিবারের সীমানার মধ্যে পড়েছে। আর স্কুলের কোল ঘেঁষে তাদের বাড়ি। যার কারণে মাপযোগ করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তবে কতটুকু জায়গা তাদের বাড়ির সীমানায় এটা বলা যাচ্ছেনা। তারা মানছেনা যে তাদের জায়গার মধ্যে স্কুলের জায়গা আছে কিছু।
যেহতেু জমি নিয়ে আদালতে তো স্কুল কমিটির পক্ষ থেকে করা একটি মামলা চলমান আছে ৭ মাস ধরে। সেক্ষেত্রে আদালত তো এখনো কোন রায় দেয়নি। এমন অবস্থায় তাদের একঘরে করে রাখা কতটুকু যুক্তযোগ্য এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারছিনা। এটা গ্রাম্য মাতব্বর ও স্কুল কমিটির বিষয় বলেই তিনি ফোন কেটে দেয়।
মিরাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাফেজ মো. জিয়াউর রহমান জিয়া বলেন, আমি কিছু দিন আগে চেয়ারম্যান হিসেবে শপথ নিয়েছি। বিষয়টি নিয়ে জানা নেই। তবে অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
রাণীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ( ওসি ) শাহীন আকন্দ বলেন, একঘরে করে রাখা এবং মারপিটের বিষয়ে ভুক্তভোগীরা থানায় কোন লিখিত অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুশান্ত কুমার মাহাতো বলেন, জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি এবং উভয় পক্ষকে আমার দপ্তরে ডেকেছি। আসা করছি তারা আসবেন এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধান হবে।
এ বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান বলেন, রাণীনগরে জমির মালিকানা বিরোধের জের একঘরে করে রাখার বিষয়টি সুরাহার জন্য ইউএনওকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেহেতু এখনও সমাধান হয়নি, আমি দেখছি বিষয়টির কিভাবে সুরাহা করা যায়।