প্রধান শিক্ষক হয়েও যান না বিদ্যালয়ে, করেন ঠিকাদারি

নওগাঁ প্রতিনিধি, আরটিভি নিউজ

শুক্রবার, ১২ আগস্ট ২০২২ , ০৯:১৬ এএম


প্রধান শিক্ষক হয়েও যান না বিদ্যালয়ে, করেন ঠিকাদারি
ছবি : সংগৃহীত

নওগাঁ সদর উপজেলার হাঁসাইগাড়ী ইউনিয়নের কাঁকনসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক আবদুল গফুর বিদ্যালয়ে যান না ঠিকমতো। এসএসসি ও এইচএসসি পাস করা ছাত্রদের দিয়ে স্কুলে পাঠদান করান। মাস শেষে সরকারি কোষাগার থেকে বেতন তুলে নেন। এমন বিভিন্ন রকমের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।

বিজ্ঞাপন

বিষয়টি নিয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে বিদ্যালয়টির শিক্ষার পরিবেশ দ্রুত ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন অভিভাবকরা।

সরেজমিনে জানা যায়, নওগাঁ সদর উপজেলার হাঁসাইগাড়ী ইউনিয়নের কাঁকনসী গ্রামে কাঁকনসী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৭২ সালে। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করায় কাঁকনসী, ভীমপুর, চকমহাদেব, চকগোপালসহ আশেপাশের ৫ থেকে ৬টি গ্রামের শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় রয়েছে। ১৯৮৯ সালের ১ এপ্রিল বিদ্যালয়টিতে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন সদর উপজেলার দুবলহাটি ইউনিয়নের ফতেহপুর গ্রামের বাসিন্দা আবদুলল গফুর। যোগদানের ২৪ বছর পর ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি পান। নীতিমালা অনুযায়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত কোনও শিক্ষকের ঠিকাদারি কাজে সম্পৃক্ত থাকার নিয়ম নেই। তবে এই নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন আবদুল গফুর। সুকৌশলে স্ত্রীর নামে করিয়েছেন বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) সরকার নিবন্ধিত ঠিকাদারি লাইসেন্স। কয়েকবছরের মধ্যেই হয়েছেন বিএমডিএ’র প্রভাবশালী ঠিকাদার। 

বিজ্ঞাপন

তার স্ত্রীর নামে ‘মেসার্স মাস্টার এন্টারপ্রাইজ’ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ঠিকাদারি কাজেই বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকেন আবদুল গফুর। এজন্য ব্যবসায়ীদের কাছে পরিচিতি পেয়েছেন ‘গফুর ঠিকাদার’ হিসেবে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ব্যবসায়িক কাজে ব্যস্ততার কারণে নিয়মিত বিদ্যালয়ে যান না আবদুল গফুর। রুটিনে থাকা নিজের নামে ক্লাসগুলো এসএসসি ও এইএচএসসি পাস করা ছেলেদের দিয়ে করান।

দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয়টি এভাবে চলতে থাকায় বাকি তিনজন সহকারী শিক্ষকও এখন সময়মতো বিদ্যালয়ে আসেন না। শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে এসে সময়মতো শিক্ষকদের না পাওয়ায় পড়ালেখার আগ্রহ হারাতে বসেছে। এসবের প্রতিকার চেয়ে গত ১৮ জুলাই জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী।

বিজ্ঞাপন

কাঁকনসী গ্রামের বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম বলেন, প্রধান শিক্ষক মাসে দু-একবার বিদ্যালয়ে আসেন। তাহলে এখানে পড়ালেখা ঠিকভাবে হবে কীভাবে। উনি তো শিক্ষক নয়, ঠিকাদার। এলাকার বিভিন্ন বেকার ছেলেদের মাসে দুই থেকে তিন হাজার টাকা বেতন দিয়ে তিনি তার পরিবর্তে ক্লাস করান। রাজমিস্ত্রীকে দিয়েও এখানে ক্লাস করানো হয়েছে। আমার মেয়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে। এখানে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। তাই মেয়েকে এই স্কুলে পাঠিয়ে প্রতিনিয়ত শঙ্কায় থাকতে হয়। 

একই গ্রামের আব্দুর রশিদ, ময়েন উদ্দিন, শাহীনুর রহমানসহ অনেকেই বলেন, প্রভাবশালী ঠিকাদার হওয়ায় প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে আমরা কেউ প্রতিবাদ করতে পারি না। নাটোর সমবায় অফিসের এক কর্মচারীকে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বানিয়ে তিনি বিদ্যালয় সংস্কারে বরাদ্দকৃত টাকা প্রতিনিয়ত আত্মসাৎ করে আসছেন। অভিভাবক সদস্য, এলাকাবাসী কাউকেই তিনি কমিটি গঠনের বিষয়টি জানায়নি। পুরো পরিবারে নাটোরে থাকা সভাপতির ছেলেকে এই বিদ্যালয়ে ছাত্রত্ব দেখিয়েছে। গ্রামে তারা খুবই কম আসেন। অথচ তার ছেলেকে বিদ্যালয়ের হাজিরা খাতায় উপস্থিত দেখানো হয়। বিদ্যালয়টির শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে অবৈধ সভাপতিকে প্রত্যাহার এবং প্রধান শিক্ষকের অনিয়ম ক্ষতিয়ে দেখে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাই।

তবে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য করেননি বিদ্যালয়ের বাকি তিনজন সহকারী শিক্ষক।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক আবদুল গফুর বলেন, ম্যানেজিং কমিটিতে কে সভাপতি হবেন, সেটা এখানকার রাজনৈতিক নেতারা নির্বাচন করে দেন। এখানে আমার হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। আমার জানা মতে সরকারি অফিসে চাকরি করলেও সভাপতি হওয়া যায়। নিয়ম মেনেই সঠিকভাবে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। আমার রুটিনে থাকা ক্লাসগুলো কখনোই অন্যজনকে দিয়ে করানো হয়নি। সঠিক সময়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে নিজেই ক্লাসগুলো নিয়েছি। আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো সঠিক নয়।

শিক্ষকতার পাশাপশি ঠিকাদারি করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বিএমডিএর ঠিকাদারি লাইসেন্স রয়েছে এটা সঠিক। তবে সেটা আমার স্ত্রীর নামে। আমি শুধু কাজগুলো মাঝেমধ্যে দেখভাল করি। নিজের নামে যেহেতু লাইসেন্স নেই, সেহেতু চাকরিতে এই লাইসেন্সের কোন প্রভাব পড়বে না।

সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ইতিয়ারা পারভীন বলেন, বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে আনা অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করে দেখতে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

নওগাঁ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সিদ্দীক মোহাম্মদ ইউসুফ রেজা বলেন, বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ উঠেছে। একজন প্রধান শিক্ষক কখনোই ঠিকাদারির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারবেন না। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নওগাঁ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সিদ্দীক মোহাম্মদ ইউসুফ রেজা বলেন, সরকারি দপ্তরে কর্মরত কোন কর্মচারী কখনোই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি হতে পারেন না। এটা সম্পূর্ণ নিয়ম বহির্ভূত। কাঁকনসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি গঠনে এমনটি হয়েছে মর্মে ওই এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। এছাড়ও বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ উঠেছে। একজন প্রধান শিক্ষক কখনোই ঠিকাদারির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারবেন না। বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের মাধ্যমে দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে সভাপতিকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার পাশাপাশি অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন

Loading...


© All Rights Reserved 2016-2025 | RTV Online | It is illegal to use contents, pictures, and videos of this website without authority's permission