মার্চ-এপ্রিল দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে হলেও চাঁদপুরের পদ্মা মেঘনায় ইলিশ ধরা পড়ছে না। মাছঘাট ক্রেতা বিক্রেতার হাঁকডাকে সরগরম হওয়ার কথা থাকলেও সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে মৎস্য বিক্রেতা ও শ্রমিকদের অলস সময় কাটাতে। আবার নদীতে মাছ না পেয়ে নৌকায় অলস সময় কাটাচ্ছেন জেলেরা। কার্যত পদ্মা মেঘনায় দেখা দিয়েছে ইলিশের খরা। আর এর প্রভাব পড়েছে স্থানীয় মাছ বাজারগুলোয়। জেলেরা ৯/১০ ঘণ্টা নদীতে জাল ফেলে কিছু দেশীয় প্রজাপতি মাছ নিয়ে তীরে আসে। কেউ কেউ এর সঙ্গে ২/৪টি ইলিশ নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে ঘাটে আসে। এতে করে ইলিশ মাছের দাম যেমন আকাশচুম্বী, তেমনই দেশীয় প্রজাতির মাছগুলোর দামও থাকে চওড়া। ফলে মাছ কিনতে আসা ক্রেতারা মাছের চওড়া দাম শুনে হতাশ হয়ে ফিরে যায়।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ইলিশের অবতরণ কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত চাঁদপুর মাছঘাট। সেই মাছঘাটে গত ৭ দিন যাবত অনেকটা ইলিশশূন্য হয়ে আছে। এখানকার পদ্মা-মেঘনা নদীতে জেলেদের জালে ইলিশ ধরা না পড়ায় এ অবস্থা বলে জানা যায়। অথচ বিগত বছরে মৌসুমের এ সময় এখানে প্রতিদিন সাত থেকে ৮০০ মন ইলিশ মাছ কেনাবেচা হয়েছিল। বর্তমানে মাছঘাটে অধিকাংশ ব্যবসায়ী অলস সময় পার করছেন। গত ৩০ এপ্রিল মধ্যরাত থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার পর থেকে চাঁদপুরের অর্ধ লক্ষাধিক জেলে মাছ শিকারে নদীতে নেমেছে।
মানুষের যে পরিমাণ চাহিদা সে অনুযায়ী ঘাটে ইলিশ না থাকায় দাম বেশি। ট্রলারের ডিজেল খরচ করে প্রতিদিন কিছু কিছু জেলের জালে ইলিশ ওঠে ৪/৫টি। সাথে কিছু বাইলা, চেউয়া, চিংড়ি, ভাটামাছ। আবার কেউ কেউ ২/৩টি পাঙ্গাশ ও আইড় মাছ নিয়েও ঘাটে আসে। সব মিলিয়ে এগুলো বিক্রি করে ডিজেলের খরচই মেটে না। প্রতিদিনই জাল ফেলে লোকসান গুনছেন জেলেরা। পরিবার নিয়েও আছেন বিপাকে। বড় স্টেশন মাছ ঘাটে ইলিশের পরিবর্তে চাষের রুই–কাতলাসহ বিভিন্ন মাছের পসরা সাজিয়ে বসে থাকতে দেখা যায় বিক্রেতাদের। বর্তমানে যে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে এর মধ্যে ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ মাছ বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৪০০ টাকা থেকে ২৬০০ টাকা দরে। ১ কেজি বা তার ওপর ওজনের মাছ বিক্রি হচ্ছে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা দরে। যা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে।
বেশ কয়েকজন জেলের সঙ্গে কথা হলে তারা জানায়, নদীতে মাছ নেই। মাছ ধরার জন্য যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়, তা তুলতে পারছে না জেলেরা। অনেকের সংসার চলছে ধারদেনা করে। অথচ অন্যান্য বছর এ সময়ে নদীতে আরও বেশি মাছ পাওয়া যেত। শুধু ইলিশই নয়, এ বছর তাদের জালে অন্য মাছও তেমন একটা মিলছে না। যা মিলছে দেশীয় প্রজাতির সামান্য কিছু ছোট মাছ। তারাও এখন অলস সময় কাটাচ্ছে। নদীতে মাছ না থাকায় অনেক জেলে নদীতে নামছে না। অনেকে আবার অন্য পেশায় চলে গেছে।
মৎস্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, বৃষ্টি, ঝড় তুফানের ওপর নির্ভর করে ইলিশ। নদী যত উত্তাল থাকবে ইলিশের বিচারণ তত বেশি থাকবে। তাছাড়া নদীর পানও দূষণ। নদীতে গভীরতা কম, আবহাওয়া মাছের অনুকূলে নয়। সাগরে অভিযান থাকায় আশপাশের জেলার নদীর ইলিশ ঘাটে আসছে না। মাছ না পাওয়ায় দামও চড়া। তবে ঘাট সরগরম হওয়া শুরু হলে দাম কিছুটা কমবে বলে জানা ব্যবসায়ীরা।
মৎস্য কর্মকর্তারা জানান, নদীতে পানির চাপ কম থাকায় এখন জেলেদের জালে তেমন ইলিশ ধরা পড়ছে না। বাজারেও ইলিশ আসছে না। সামনে পূর্ণিমা। তখন নদীতে পানির চাপ বাড়বে। তখন প্রত্যাশিত ইলিশও পাওয়া যাবে।
চাঁদপুর মৎস্য সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক শবে বরাত বলেন, এখন ইলিশের মৌসুম নয়। তাই মাছের পরিমাণ কম। মূলত নদীতে যখন পানি বেশি থাকে এবং স্রোত থাকে, তখন ইলিশ মাছ বেশি পাওয়া যায়। কেননা ইলিশ গভীর জলের মাছ। পানি বেশি হলে স্রোতের সঙ্গে এরা চলাফেরা করে। নদীতে পানি বাড়লে আবারও ইলিশ বেশি ধরা পড়বে। তখন হয়তো দামও কমবে।
তিনি আরও জানান, এখন সাগরে অভিযান চলছে। তাই নামার মাছও আসছে না। তবে এবার সরকার একটি ভালো কাজ করেছে। ভারত এবং বাংলাদেশ একই সময় এবং পাশাপাশি অভিযান দেয়ায় মৎস্য ব্যবসায়ী ও জেলেদের জন্য উপকার হয়েছে। তিনি আসা করেন, আগামী ২/১ মাসের মধ্যে ইলিশের আমদানি বাড়তে পারে। আবার তিনি আশঙ্কাও করেন, এভাবে ইলিশ মাছ পাওয়া না গেলে অনেক মৎস্য ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে যাবে।
ইলিশ গবেষক ও মৎস্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিছুর রহমান জানালে, এ বছর জাটকা ইলিশ যেভাবে সুরক্ষা হয়েছে, তাতে করে তিনি আশা করেন এ বছর ইলিশ মাছের উৎপাদন পৌনে ৬ লাখ টন পৌঁছে যাবে।
১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত জাটকা সংরক্ষণে দেশের অন্যতম অভয়াশ্রম কেন্দ্র চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল থেকে হাইমচর উপজেলার চরভৈরবী পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার এলাকায় ইলিশসহ সব ধরনের মাছ আহরণ নিষিদ্ধ ছিল।
আরটিভি/এএএ/এস