ছুটির ঘণ্টা, সারেং বউ, গোলাপী এখন ট্রেনে, সীমানা পেরিয়ে, সুতরাং- এগুলো এ দেশের ক্ল্যাসিক ছবি। ছবিগুলো সেই সময়ের যখন শিল্প আর বাণিজ্যের মধ্যে ব্যবধান ছিল সামান্য। ষাটের দশক তো রীতিমতো স্বর্ণ প্রসবিনী। সেই দশকে বাণিজ্য ততটা গেড়ে বসেনি। সেলুলয়েডে শিল্পচর্চাটাকেই প্রধান মনে করা হতো। স্বাধীনতার পর চলচ্চিত্র ব্যবসার রমরমা শুরু হলো। এতে শিল্প কিন্তু অস্তাচলে গেল না। বাণিজ্য ও শিল্প হাত ধরাধরি করে চলতে শিখল সত্তরের দশকেই।
তখনকার বড় ছবিগুলো যদি দেখেন, সবকটা ছবি শিল্পের দাবি মিটিয়েই জনপ্রিয় হয়েছে। শিল্পসম্মত ছবিও চুটিয়ে ব্যবসা করেছে। একই ছবি সমালোচকদের তৃপ্ত করছে, হল মালিকদের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে, আবার জুরি বোর্ডেরও মন জোগাচ্ছে। সেই সময় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ব্যবসাসফল ছবির দাপট ছিল দেখার মতো। পুরস্কার, শিল্প ও ব্যবসা- চলচ্চিত্রের এই তিন দিক একই দিগন্তে এসে মিলত তখন।
নব্বইয়ের দশকে এসে সব গোলমাল হয়ে গেল। শিল্পসম্মত ছবি আর ব্যবসা করে না। ব্যবসাসফল ছবিতে নন্দনতত্ত্বের ছিঁটেফোটা নেই। জনপ্রিয় ছবি আর জাতীয় পুরস্কারে সুবিধা করতে পারে না। এই শুরু হলো বিভাজনের খেলা। এক যুগ আগেও অবস্থাটা নরকতুল্য হয়ে যায়নি, যেমনটা আজকাল হয়েছে।
‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ কিছুটা ব্যবসা করছে, আবার পুরস্কারও পাচ্ছে। শিল্পের জায়গায় হয়তো খানিক ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। মোটামুটি ধরনের একটা ভারসাম্য রাখতে পারছে ‘ইতিহাস’-এর মতো ছবিগুলো। এগুলো দেশব্যাপী সিনেমা হলে চলছে আবার পুরস্কার প্রতিযোগিতায় ভালো ফল করছে। এই পরিস্থিতিও মেনে নেওয়ার মতো ছিল। কিন্তু এখন যা হয়েছে তা আর কহতব্য নয়।
গত ৭/৮ বছরে সিনেমার বিভাজন হয়েছে ধ্বংসাত্মক। ‘অজ্ঞাতনামা’, ‘আন্ডারকনস্ট্রাকশন’, ‘রেহানা মরিয়ম নূর’, ‘চন্দ্রবতীকথা’র মতো প্রশংসিত ছবি তৈরি হয়েছে। কিন্তু এগুলো লোকে দেখেনি সিনেমা হলে গিয়ে। জাতীয় পুরস্কার পাচ্ছে না ‘জালালের গল্প’, ‘উনপঞ্চাশ বাতাস’ এর মতো আলোচিত ছবি। ‘কমলা রকেট’, ‘মেঘমল্লার’ এর মতো ছবি দেশের কোথাও চলছে না। অন্যদিকে ‘নবাব’, ‘শিকারী’র মতো ব্যবসাসফল ছবিগুলো মানবিচারে একেবারেই দুর্বল।
মোদ্দা কথা দাঁড়াচ্ছে- যে ছবি লোকে দেখছে সে ছবিতে শিল্পের গন্ধ থাকছে না। যে ছবিতে শিল্পের গন্ধ থাকছে সে ছবি সিনেমা হলে চলছে না। আর যে ছবি জাতীয় পুরস্কার পাচ্ছে- সে ছবি না লোকপ্রিয় না শিল্পসম্মত। দেশে ভালো ছবি হচ্ছে, সেসব ছবি কালোত্তীর্ণ হয়তো নয়। এই ধরনের ছবিগুলো দর্শকরা দেখছে কম।
শিল্পসম্মত ছবি আমাদের তরুণরা বানাতে পরে, সেই প্রমাণ তারা বহুবার দিয়েছে। ব্যর্থতা বেশি জনপ্রিয় ছবির নির্মাতাদের। এখন প্রচুর জনপ্রিয় ছবি হওয়া দরকার। বিনোদন ছবি মৃত ইন্ডাস্ট্রিকে জাগিয়ে তুলবে। অনেকগুলো মাল্টিপ্লেক্স হয়েছে দেশে। এই হলগুলো থেকে পুঁজি তুলে আনা সম্ভব, শুধু দরকার সুপারহিট ছবি।
‘হাওয়া’ এমনই একটি সুপারহিট ছবি। ছবিটি সমালোচক ও দর্শকরা হাত ধরাধরি করে দেখেছেন। এই দৃশ্য সত্তর দশকের পরে বলতে গেলে হারিয়েই গিয়েছিল। ভালো ছবির সঙ্গে জনপ্রিয় ছবির যে বিরোধ, ‘হাওয়া’ সেই বিরোধ মিটিয়েছে। আর্ট ও পপুলারিটির ফারাক ঘুচিয়েছে এ ছবি।
মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত ‘হাওয়া’ সোনালী যুগের মানের সঙ্গে তুলনীয় একটা ছবি, যখন আর্ট ও বিজনেসের মাঝখানে দেয়ালটা ছিল নড়বড়ে। তবে হ্যাঁ, তখন ‘হাওয়া’র মতো ছবি প্রতি বছরই হতো। আর এখন, আরেকটা ‘হাওয়া’ কবে আসবে তা কেউ জানে না।
লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, আরটিভি