‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’, ‘রেল লাইনের ওই বস্তিতে’ কিংবা ‘আলাল ও দুলাল’ গানগুলোর কথা মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাংলাদেশের পপ ও ব্যান্ড সংগীতের ‘গুরু’ আজম খানের কথা। গানের প্রতি, বিশেষ করে গণসংগীতের প্রতি একটা বাড়তি টান থেকেই নিজেকে সংগীত জগতে বিলিয়ে দেন তিনি। অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা আজম খান।
এদিকে, জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এ বছর মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছেন পপগুরু আজম খান। মৃত্যুর ১৪ বছর পর এ সম্মানে ভূষিত হচ্ছেন তিনি।
পুরো নাম মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান হলেও সঙ্গীতাঙ্গনে তিনি আজম খান নামে পরিচিত। অনেকে তাকে গুরু সম্বোধন করে থাকেন। ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আজিমপুর সরকারি কলোনির ১০ নম্বর কোয়ার্টারে জন্ম তার। বাবা আফতাবউদ্দিন আহমেদ, মা জোবেদা খাতুন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের একটি প্রজন্মকে রক-পপে প্রভাবিত করেছেন আজম খান। শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা উপমহাদেশেও আজম খান পেয়েছিলেন অসাধারণ জনপ্রিয়তা।
আজম খানের জন্ম আজিমপুরে হলেও ছয় বছর বয়সে চলে যেতে হয় কমলাপুরে। ফলে, সেখানেই বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা। পারিবারিক আবহে গানের চর্চাটা ছিল। তাই তিনিও টুকটাক গান করতেন। কিন্তু তখনো সঙ্গীত নিয়ে ভাবেননি কিংবা ভাবার বয়সও ছিল না। তবে গণসঙ্গীত তাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করত। তাই স্কুলজীবনেই প্রতিবাদের সুর কণ্ঠে তুলে নেন।
দেশে তখন স্বাধীনতা যুদ্ধের অঙ্কুরোদগম হচ্ছে ধীরে ধীরে। পাকিস্তানি শাসকরা যে দেশের মানুষকে ঠকাচ্ছে, নানান দিক থেকে বঞ্চিত করছে, এসব বুঝতে পারেন তিনি। সেই সূত্রেই মনের ভেতর বিপ্লবী সত্তার জন্ম হয়। গণসঙ্গীতের দল 'ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর কথা শুনতে পান। এরপর তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গাইতে থাকেন গণসঙ্গীত। প্রথমে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা, অতঃপর ঢাকার আশপাশেও প্রতিবাদ আর অধিকারের সুর নিয়ে ছুটে যান।
তখন তিনি একুশের টগবগে তরুণ। নানান ধাপ পেরিয়ে শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। দেশ স্বাধীনের এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। অদম্য সাহস বুকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন যুদ্ধে যাবেন। ভয়ে ভয়ে বাবাকে কথাটা জানালেন। বাবা তাকে আদেশ দেন, যুদ্ধে যাবি যা, কিন্তু দেশ স্বাধীন করে তবেই ঘরে ফিরবি।
বাবার সেই কথা অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন তিনি। ট্রেনিং নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। সেকশন কমান্ডার হয়ে সম্মুখ যুদ্ধে যেমন ছিলেন, তেমনি গেরিলা যুদ্ধেও বীরের ভূমিকা পালন করেছেন। এর ফাঁকে ক্যাম্পে ক্যাম্পে গান গেয়ে সহযোদ্ধা ও মানুষকে উৎসাহ দেওয়ার কাজটিও বাদ রাখেননি।
দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলো। চারদিকে বয়ে এলো স্বস্তির বাতাস। তখন তার মনে প্রশ্ন এলো, এবার কী করবেন? ভেবেচিন্তে দেখলেন, গানটাই তার আয়ত্তে আছে। এদিকেই মনোযোগ দেওয়া যাক।
গানের চর্চা থাকায় আন্তর্জাতিক ব্যান্ড মিউজিকের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে ছোটবেলাতেই। 'বিটলস', ‘দ্য শ্যাডোজ’ কিংবা ‘রোলিং স্টোন’র গান শুনে পশ্চিমা মিউজিকে আগ্রহ জন্মায়। সেই আবহে একটা দেশি রূপ দেওয়ার চেষ্টা করলেন। সরল কথা- সুরে বাঁধতে শুরু করলেন গান। পপ ঘরানার সেসব গান তখন এই তলস্নাটে একেবারে অচেনা। তিনি পথিকৃৎ হয়ে চেনালেন, জনপ্রিয় করে তুললেন। এ জন্য সবাই তাকে ‘পপগুরু’ বলে অভিহিত করেন।
১৯৭২ সালে বন্ধুদের নিয়ে ‘উচ্চারণ’ নামে একটি ব্যান্ড গঠন করেন তিনি। একই বছর বিটিভিতে গান গাওয়ার সুযোগ পান। সেখানে ‘এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ ও ‘চার কালেমা সাক্ষী দেবে’ গান দুটি গেয়ে দেশজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পান। ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে তিনি সৃষ্টি করলেন কালজয়ী গান ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে’। যা এখনো মানুষের মুখে মুখে।
পরবর্তী সময়ে আরও বহু গানে শ্রোতাদের মনে ঝড় তুলেছিলেন তিনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- ‘আমি যারে চাই রে’, ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’, ‘আলাল ও দুলাল’, ‘অনামিকা’, ‘অভিমানী’, ‘আসি আসি বলে’, ‘হাইকোর্টের মাজারে’, ‘পাপড়ি’, ‘বাধা দিও না’, ‘যে মেয়ে চোখে দেখে না’ ইত্যাদি।
শুধু গান নয়, তিনি অভিনয় ও মডেলিংও করেছেন। ১৯৮৬ সালে ‘কালা বাউল’ নামে হিরামনের একটি নাটকে কালা বাউলের চরিত্রে এবং ২০০৩ সালে শাহীন-সুমন পরিচালিত ‘গডফাদার’ চলচ্চিত্রের নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। এ ছাড়া কিছু বিজ্ঞাপনচিত্রে মডেল হিসেবেও তাকে দেখা গেছে।
সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৯ সালে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক দেওয়া হয়। যদিও এর ৭ বছর আগেই, ২০১১ সালের ৫ জুন তিনি চলে যান না ফেরার দেশে।
আরটিভি/এএ/এস