বিয়ের ‘প্রলোভনে ধর্ষণ’র সঙ্গে আমরা মোটামুটি পরিচিত। প্রায়ই এ সংক্রান্ত খবর পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনে প্রচার হয়। একজন পুরুষ ‘বিয়ের আশ্বাস’ দিয়ে একজন নারীর সঙ্গে যৌনমিলন করলে এবং পরবর্তীতে তিনি ওই নারীকে বিয়ে না করার কথাই বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের সারকথা।
এতোদিন আমাদের দেশে প্রচলিত আইনে ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ কথাটি ছিল না। কিন্তু এরপরও এই অভিযোগ মামলায় উল্লেখ করা হতো। এবার আইনে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গত ২০ মার্চ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়ায় বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখন যেহেতু সংসদ নেই, সেহেতু রাষ্ট্রপতি এটাকে অধ্যাদেশ হিসেবে জারি করতে পারেন। কিন্তু ধর্ষণের প্রচলিত আইনের সংজ্ঞার সঙ্গে ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ সাংঘর্ষিক। কেননা, প্রলোভন অর্থ হলো লোভের বশবর্তী হয়ে কোনও কাজ করা। আর ধর্ষণ হলো জোর করে কিংবা ভয় দেখিয়ে সম্মতি নিয়ে যৌন মিলন করা। যদি বিয়ের আশ্বাসে কোনও নারী কোনও পুরুষের সঙ্গে সহবাস করে; এক্ষেত্রে নারীর সম্মতি থাকে। আর সম্মতি থাকা মানে ধর্ষণ নয়, অর্থাৎ জোর করে যৌন মিলন নয়। কারণ যৌন মিলনের আগে তারা একটা মৌখিক চুক্তিতে আবদ্ধ হন। পরে যদি ওই পুরুষ ওই নারীকে বিয়ে না করেন, তাহলে শর্তভঙ্গ বা প্রতারণা ধরে নেওয়া যায়। এক্ষেত্রে নারীর মতো পুরুষও প্রতারণার শিকার হতে পারেন।
ধর্ষণের সংজ্ঞা ও শাস্তি: ধর্ষণ মামলার বিচার করা হয় ১৮৬০ সালে প্রণীত দণ্ডবিধি অনুযায়ী। দণ্ডবিধির ৩৭৫ নম্বর ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। ২০০০ সালের ৮ নং আইনে এ বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়। এটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ নামে পরিচিত। পরে আইনটি কয়েকবার সংশোধন করা হয়। এ আইনের ৯ নং ধারায় পাঁচ অবস্থায় কোনও নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনকে ধর্ষণ বলা হয়েছে। ১. যদি কোনও পুরুষ কোনও নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি [মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে] দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন। এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, যদি কোনও পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত [ষোল বৎসরের] অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া, অথবা [ষোল বৎসরের] কম বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।
২. যদি কোনও ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী তাহার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে [ধর্ষণের শিকার] নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন। ৩. যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনও নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন এবং ধর্ষণের ফলে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহা হইলে ঐ দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন। ৪. যদি কোন ব্যক্তি কোনও নারী বা শিশুকে- (ক) ধর্ষণ করিয়া মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি [মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে] দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন;
(খ) ধর্ষণের চেষ্টা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বৎসর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন। ৫. যদি পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে কোন নারী [ধর্ষণের শিকার] হন, তাহা হইলে যাহাদের হেফাজতে থাকাকালীন উক্তরূপ ধর্ষণ সংঘটিত হইয়াছে, সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ [ধর্ষণের শিকার] নারীর হেফাজতের জন্য সরাসরিভাবে [দায়িত্বপ্রাপ্ত] ছিলেন, তিনি বা তাহারা প্রত্যেকে, ভিন্নরূপ প্রমাণিত না হইলে, হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য, অনধিক দশ বৎসর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূন দশ হাজার টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।
বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ নাকি প্রতারণা: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ইশরাত হাসান বলেছেন, ‘ধর্ষণ কখনো সম্মতিতে করা সম্ভব না। যদি সম্মতি আদায় করা হয় তখন আবার প্রশ্ন চলে আসে এই সম্মতিটা কীভাবে আদায় করা হয়েছে? যেহেতু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এর ব্যাখ্যা দেয়া নেই, তখন আবার আমাদের দণ্ডবিধিকে সাথে নিয়েই চলতে হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী তারিক রিজভী বলেন, নারী যে সম্মতিটা দিলো, সেটা কি স্বেচ্ছায় দিলো না কোনো না কোনো প্রলোভন দেখিয়ে বা প্রতারণা করে সম্মতিটা আদায় করা হচ্ছে? সম্মতিটা প্রতারণামূলকভাবে হয়েছে কি না, সে বিষয়টাই আইনে বলা হচ্ছে। অর্থাৎ কোনও পুরুষ যদি ভবিষ্যতের আশ্বাস দিয়ে কোনও নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং পরে সেই প্রতিশ্রুতি না রাখেন, তবে সেটা প্রতারণা হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তবে আইন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভবিষ্যতের কোনও ধরনের প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন এবং পরে সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার বিষয়টিকেই বর্তমানে ‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ’ মামলায় ব্যবহার করা হচ্ছে।
নতুন আইনটি বৈষম্যমূলক: একটি বিষয় খুব ভালো করে খেয়াল করতে হবে। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যৌনমিলন করলেই অপরাধ হবে; নাকি বিয়ে না করলে অপরাধ হবেÑ তা আইনে স্পষ্ট নয়। বিয়ের প্রতিশ্রুতি কিন্তু উভয়কেই দিতে হয়। বিয়ের আশ্বাস দিয়ে শারীরিক সম্পর্কের বিয়ে না করলে পুরুষের ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে আইনের খসড়ায়। তবে একই ধরনের অপরাধ নারী করলে কী হবে, তা আইনে নেই! শারীরিক সম্পর্কের পর যদি প্রতিশ্রুতি ভেঙে কোনও নারী অন্য ব্যক্তিকে বিয়ে করেন; তাহলে পুরুষ সঙ্গীটি কী ওই নারীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করতে পারবেন? পারবেন না। শুধু তা-ই নয়, এ আইনে নারীকে ছোট করে দেখা হচ্ছে। কেননা, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিলেই একজন নারী শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে রাজি হবেন? তার কী কোনও বোধ-বুদ্ধি নেই?
সম্মতির ভিত্তিতে যৌন সম্পর্ক ধর্ষণ নয়: মনোয়ার হোসেন বনাম রাষ্ট্র মামলায় সুপ্রিম কোর্ট ঐতিহাসিক রায় দেন। এতে বলা হয়, যদি কোনও ব্যক্তি ১৬ বছরের বেশি বয়সী কোনও নারীর সঙ্গে বিয়ের প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং তা পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে হয়, তাহলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না। প্রতিটি মামলার পরিস্থিতি এবং সম্পর্কের প্রকৃতি অনুযায়ী বিষয়টি মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। এদিকে, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে ধর্ষণ হবে না বলে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নাইম আহমেদ বনাম রাষ্ট্র মামলায় রায় দেন। এ বিষয়ে যতদূর জানা যায়, আসামি নাইম আহমেদের সঙ্গে এক বিবাহিত নারীর প্রেম ছিল। তার স্বামী-সন্তান ছিল। শারীরিক সম্পর্কের ফলে ওই নারী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর নাইম তাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেন। এই আশ্বাসে ওই নারী স্বামীকে তালাক দিয়ে সন্তান-সন্ততি ফেলে বিয়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। এক পর্যায়ে নাইম বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানান এবং পালিয়ে যান। পরে তার বিরুদ্ধে ওই নারী ধর্ষণের মামলা করেন। দায়রা আদালত নাইমকে ১০ বছর কারাদণ্ড; ৫ হাজার টাকা জরিমানা ও ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের আদেশ দেন। বোম্বে হাইকোর্ট সাজা কমিয়ে ৭ বছর কারাদণ্ড দেন এবং জরিমানা বহাল রাখেন। নাইম সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। ওই নারী তার নিজের দায়িত্ববোধ ও নৈতিকতা ভুলে স্বেচ্ছায় নাইমের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেছেন বলে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেন। একই সঙ্গে ধর্ষণের অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেন আদালত।
প্রমাণে জটিলতা: আইন তো প্রমাণ ছাড়া কাউকে দোষী বলতে পারে না। কিন্তু সংশোধিত আইনে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। ধরুন, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক যুগল যৌন মিলনে লিপ্ত হলো। যেহেতু সম্মতিতে যৌন মিলন হলো, কারো কোনও অভিযোগ থাকল না। ছয় মাস, এক বছর কিংবা আরও পরে ওই নারী ধর্ষণের অভিযোগ আনলেন। মেডিকেল পরীক্ষায় হয়তো যৌন মিলনের প্রমাণ পাওয়া যাবে। কিন্তু কার সঙ্গে যৌন মিলন হয়েছে, সেটা কীভাবে প্রমাণ হবে? কারণ একটা নির্দিষ্ট সময় পর তো আলামত নষ্ট হয়ে যায়। আবার অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি আদালতে দাবি করেন অভিযোগকারী নারীর সঙ্গে তিনি শারীরিক মিলন করেননি। তখন কী হবে? অভিযুক্ত ব্যক্তিই যে দোষী, সেটা কীভাবে প্রমাণ হবে?
ব্ল্যাকমেইলিং বাড়ার আশঙ্কা: প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করা নৈতিক-সামাজিক বিষয় হতে পারে। এটা কোনওভাবেই আইনগত অপরাধ হিসাবে বিবেচনা ন্যায়সঙ্গত নয়। টানাপোড়েন, মতপার্থক্য বা পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণে অনেক সময় প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ক বারবার হতে পারে। নারী যখন ইচ্ছা তখন মামলা করতে পারবেন। এমনকি, প্রেম-বিচ্ছেদের ১০ বছর পরেও তিনি মামলা করতে পারবেন। আদালত বা থানায় নারী মামলা করা যাবে। অনেক নারী এই আইনকে টাকা আয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন বলে আশঙ্কা রয়েছে। কারণ নারীর পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না, প্রকাশ হবে আসামির পরিচয়। দুষ্কৃতকারীরা আড়ালে থেকে এই মামলাকে তার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহার করতে পারবেন। ফলে, থানায় থানায় চলতে পারে মামলা বাণিজ্য। এই ধরনের আইন নাগরিক অধিকার পরিপন্থি এবং অসাংবিধানিক।
লেখক: সাংবাদিক/ বার্তা সম্পাদক, ভোরের আকাশ
আরটিভি/ ডিসিএনই