চট্টগ্রামের মহেশখাল শুষ্ক মৌসুমে দুর্গন্ধ আর বর্ষায় জলাবদ্ধতা এখন যার পরিণতি। প্রথম দুঃখ চাক্তাই খালের পর চট্টগ্রামবাসীর জন্য এটি এখন দ্বিতীয় দুঃখে পরিণত হয়েছে। ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ- বন্দর রিপাবলিক ক্লাবের পাশে মহেশখালের ওপর বাঁধটি নির্মাণ করে আগ্রাবাদ-সিডিএ এলাকার জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য।
কিন্তু সেখানে বর্ষায় জলাবদ্ধতা আরো প্রকট হয়েছে। বাঁধের কারণে সেখানকার পানি আগের মত আর অপসারিত হচ্ছেনা। তাই এই বাঁধটিই এখন সমস্যার মূল কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বাঁধের কারণে বন্দর এলাকার একমাত্র স্রোতস্বিনী এবং প্রাকৃতিক খালটি এখন একটি মরা খালে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এই বাঁধের কারণে ওই খাল সংলগ্ন ৪টি ওয়ার্ডের প্রায় ১৫ লাখ মানুষের জীবনযাত্রা এবং পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে।
৩৭ এবং ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড সচেতন নাগরিক সমাজ নামে একটি সংগঠন শুরু থেকেই এই বাঁধের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছে।
সম্প্রতি এই বাঁধটি অপসারণের কথা জানিয়েছেন নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান এমপি। তার এ ঘোষণাকে দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। বাঁধ অপসারণের এই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত আছেন নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন।
তিনি আরটিভি অনলাইনকে জানান, সম্প্রতি বন্দর উপদেষ্টা পরিষদের এক সভায় বাঁধটি অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ ব্যাপারে একটি কমিটিও করে দেয়া হয়। কিন্তু এর কোন অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছিনা।
তিনি আরো জানান, সিডিএ, আগ্রবাদ এবং বন্দর এলাকার জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য মূলত মহেশখালটি খনন করতে হবে এবং সল্টগোলা ক্রসিং এলাকায় একটি স্লুইচ গেইট নির্মাণ করা দরকার। সেটি না করে অপরিকল্পিত একটি বাঁধ দিয়ে খালটিকেই মেরে ফেলা হয়েছে।
তিনি বলেন, এই বাঁধের কারণে যদি কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে তবে বাঁধ নিমাণকারীরাই এজন্য দায়ী থাকবেন।
মূলত এই বাঁধের কারণে পোর্ট পুরাতন মার্কেট, মুন্সিপাড়া, এছাক ব্রাদার্স কন্টেননার ইয়ার্ড, এক নম্বর সাইট, ধুপপুল, দীঘিরপাড়া, আদর্শপাড়া, মাইজপাড়া ঈশান মিস্ত্রীরহাট, পুরাতন ডাকঘর, হাজি আব্দুল মালুমবাড়িসহ বিস্তীর্ণ এলাকা বর্ষা মৌসুমে হাঁটু থেকে কোমর সমান পানিতে তলিয়ে যায়। প্রায় কয়েক হাজার বাড়ি, ব্যবসা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করার কারণে অসহনীয় হয়ে ওঠে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।
৭০ নম্বর পোর্ট মেইন মার্কেটের বনফুলের পরিবেশক এস এম নাসিরুদ্দিন জানান, গেল বর্ষা মৌসুমে এই বাঁধের কারণে এখানকার ব্যবসায়ীদের প্রায় ৩ কোটি টাকার পণ্য নষ্ট হয়েছে। আর ভাটার সময় মশা, মাছি এবং দুর্গন্ধ এতটাই বাড়ে যে এর আশপাশ দিয়ে চলাচল করাই কষ্টকর। বিশেষ করে শিশুরা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। যত দ্রুত সম্ভব এটা ভেঙে ফেলা দরকার।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাঁধের দুই দিকেই পঁচা, দুর্গন্ধযুক্ত কালো পানির কারণে বোঝার উপায় নেই যে এটি একটি খাল। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এই শুষ্ক মৌসুমেও তাদের নিস্তার নেই।
মধ্যম হালিশহর ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের মুনির নগরের বাসিন্দা নুরুল আলম জানান, ‘এই বাঁধ দেয়ার পর থেকে মশা, মাছি বেড়েছে। খালের দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশের কারণে এক দুর্বিসহ অবস্থার মধ্যে আছি। দুর্গন্ধের কারণে মসজিদে ঠিকমত নামাজ পড়াও কষ্টকর। বাঁধটা ভেঙে ফেললে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
আদর্শপাড়া মসজিদ মার্কেটের সোহাইল স্টোরের মো. মারুফ জানান, এই বাঁধ দেয়ার পর থেকে সমস্যা বেড়েছে। এটা কারো পছন্দ না। আগে দোকানে অনেক কাস্টমার আসতো, আর এখন দুর্গন্ধের কারণে লোকজন আসতে চান না। বর্ষায় সমস্যা আরো বাড়বে। তাই আসছে বর্ষা মৌসুমের আগেই যেন এটি ভেঙে ফেলা হয়।
আবুল কালাম জানান, এই বাঁধের কারণে আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। সবার জন্য যেটা ভালো হয় সেরকম একটা সিদ্ধান্ত দ্রুত নেয়া উচিত।
মহেশখাল বাঁধটি বন্দর এলাকার মানুষের কাছে এখন একটি মরণবাঁধ হিসেবে পরিচিত। স্থানীয়দের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, প্রায় ২ কোটি টাকা খরচ করে অপরিকল্পিতভাবে এই বাঁধটি নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ বাঁধটি নির্মাণ শুরুর হওয়ার আগে থেকেই তারা এর বিরোধিতা করে আসছেন। আর এই বাধঁটির কারণে তাদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এটি ভেঙে ফেলতেও খরচ আছে। এভাবে অপরিকল্পিতভাবে এ বাঁধটি নির্মাণ করে যে সরকারি অর্থের অপচয় করা হল এর দায়ভার কে নেবে?
এ সম্পর্কে বন্দরের প্রশাসন এবং পরিকল্পনা বিভাগের সদস্য জাফর আলম আরটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন, স্থানীয়দের সুবিধার জন্য তাদেরই অনুরোধে বাঁধটি নির্মাণ করা হয়েছিল। যদি বাঁধটি সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাহলে এটি অপসারণ করতে বন্দর কর্তৃপক্ষের কোনো আপত্তি নেই। তবে বাঁধটি অপসারণ করা হবে কিনা এজন্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটির রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
তবে কমিটি কখন রিপোর্ট দেবে এ ব্যাপারে তার জানা নেই।
গেল বছর মে মাসে রোয়ানুর আঘাতে মহেশখালের বিপরীতে এসব এলাকায় ব্যাপক জলাবদ্ধতা দেখা দিলে স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। কয়েক হাজার মানুষ মিলে তখন মহেশখাল বাঁধ কাটতে গেলে পুলিশ তাতে বাধা দিলে সংঘর্ষ বাধে।
এতে বন্দর থানার ওসি এ কে এম মহিউদ্দিন সেলিমসহ ১৫ জন আহত হয়েছিলেন। তাই আবারো কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে মহেশখাল বাঁধটি দ্রুত অপসারণের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
এসজে