দিনাজপুরের বিরল উপজেলার মঙ্গলপুর ইউনিয়নের রুদ্রাপুর গ্রামের একটি স্কুল ‘দীপশিখা মেটি স্কুল।’ রুদ্রাপুর বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম হলেও স্কুলটির কল্যাণে এখন দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে বিখ্যাত একটি গ্রাম। এক যুগ আগেও এই গ্রামে কোনো স্কুল-প্রতিষ্ঠান ছিল না। গ্রামের ছেলে-মেয়েদের হেঁটে যেতে হতো ছ-সাত কিলোমিটার দূরে পাশের গ্রামের স্কুলে। এর ফলে অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা বাদ দিয়ে কৃষিসহ অন্যান্য কাজে জড়িয়ে পড়ত।
শিশু-কিশোরদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য দীপশিখা (নন-ফরমাল এডুকেশন ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চ সোসাইটি ফর ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট) নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ১৯৯৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর রুদ্রাপুর গ্রামে ছোট্ট পরিসরে ‘মেটি স্কুল’ গড়ে তোলে। এখানে ছাত্রছাত্রীদের নাচ, গান, অভিনয়, চিত্রাঙ্কন, দলীয় আলোচনা এবং ইংরেজি শেখানোর পাশাপাশি বিভিন্ন হাতের কাজ শেখানো হয়। বর্তমানে শিশু শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। এই স্কুলের উদ্দেশ্য আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষাদান, শিক্ষার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি, যুক্তিযুক্ত চিন্তার বিকাশ ও দলীয়ভাবে শিক্ষা গ্রহণ।
২০০২ সালে রুদ্রাপুর গ্রামে গবেষণার কাজে অস্ট্রেলিয়ার লিজ ইউনিভার্সিটি থেকে অ্যানা হেরিঙ্গার (Anna Herigar) সহ আরওকিছু শিক্ষার্থী আসেন। গবেষণা শেষে অন্যরা ফিরে গেলেও অ্যানা হেরিঙ্গার (Anna Herigar) তার গবেষণা ও স্থাপত্যবিদ্যা কাজে লাগিয়ে রুদ্রাপুরের অনন্নত শিক্ষাব্যাবস্থা প্রসারের লক্ষ্যে একটি স্কুল বানানোর পরিকল্পনা করেন। তার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে জার্মানির উন্নয়ন সংস্থার আধুনিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশের বেসরকারি সেবা সংস্থা দীপশিখা।
২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিরল উপজেলার রুদ্রাপুর গ্রামে মেটির অত্যাধুনিক মাটির স্কুলঘর নির্মাণকাজ শুরু হয়, জার্মানির ‘শান্তি’ দাতা সংস্থার অনুদানে। অস্ট্রিয়ার লিজ ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা এ স্কুল নির্মাণে অবদান রাখেন। সহযোগিতা করেন দীপশিখা প্রকল্পের কর্মীরা। জার্মান স্থপতি অ্যানা হেরিঙ্গার ও এইকে রোওয়ার্ক এই ভবনের নকশা করেন।
মেটি স্কুল নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে মাটি, খড়, বালু ও বাঁশ, দড়ি, খড়, কাঠ, টিন, রড, ইট ও সিমেন্ট। মাটি ও খড় মেশানো কাদা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এর দেয়াল, যাতে দেয়ালে ফাটল ধরতে না পারে। এ ছাড়া বৃষ্টির পানি দেয়ালে লাগলে খড়ের জন্য তা নেমে যাবে। দেয়াল তৈরির পর সুন্দর করে সমান করা হয়েছে। দেয়ালের পলেস্তরায় ব্যবহার করা হয়েছে মাটি ও বালু। মেঝের পলেস্তরার জন্য পামওয়েল ও সাবানের পেস্ট ব্যবহার করা হয়েছে, যা সাধারণভাবে ওয়াটারপ্রুফ। বাইরে থেকে পলেস্তরা না করায় স্বাভাবিকভাবে উপকরণগুলো চোখে পড়ার মতো। এছাড়াও প্রাকৃতিক উপায়ে শীতের দিনে গরম ও গরমের দিনে শীতল রাখার ব্যাবস্থা রয়েছে। স্কুলের ভবনগুলো তিনতলা পর্যন্ত। ভবনের প্রতিটি তলার সামনে লম্বা বারান্দা এবং পেছনে উঁচু থেকে নিচু করে সুন্দর একটি পথ তৈরি করা হয়েছে। নিচ তলা থেকে তিন তলায় যাওয়ার জন্য কাঠের সিঁড়ি রয়েছে। সেইসঙ্গে পেছনের পথ দিয়েও নামা-ওঠার সুযোগ রয়েছে।
ভবনের পেছনে রয়েছে ‘আনন্দালয়’ নামের কমিউনিটি থেরাপি কেন্দ্র। রাস্তার দুই ধারে লম্বা লম্বা সুপারির গাছ, গাছ পেরিয়ে মাটির তৈরি এই ভবনের কাছে গেলেই দৃষ্টি আটকে যায়! এ এক অপরূপ কারুকার্য। নিচ তলা পুরোপুরি প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য ব্যবহৃত হয়। ঘরের ভেতর রয়েছে মাটির তৈরি গুহা। এতে শিশুরা খেলাধুলা করে আনন্দে মাতে। গুহার ভেতর চলাফেরার জন্য প্রতিবন্ধীদের এক ধরনের ব্যায়াম হয়ে যায়, এটি তাদের চিকিৎসারই একটি অংশ। ভবনে আলো-বাতাস সহজে আসা-যাওয়া করতে পারে এবং ঘরগুলো পরিবেশবান্ধব। প্রতিবন্ধীদের চলাচলের সুবিধার্থে রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। দ্বিতল ভবনে প্রতিবন্ধীরা ও হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীরা যেন অনায়াসে একটি কক্ষ থেকে অন্যটিতে এবং একতলা থেকে আরেক তলায় যাতায়াত করতে পারে, সেজন্য প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রেখে নকশা সাজানো হয়েছে। আনন্দালয়ের দক্ষিণ দিকে পুকুর এবং পশ্চিম-উত্তর দিকে মেটি স্কুল। এটিও দোতলা। দুটি ভবনই একই আদলে গড়া। এ ছাড়া পুরো এলাকায় রয়েছে সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কারিগরি বিভিন্ন প্রশিক্ষণের জন্য আলাদা কক্ষ, অফিস কক্ষ ও নামাজ ঘর।
ভবনগুলো একসাথে না। একটা ভবন থেকে আরেকটা ভবন বেশ দূরে স্থাপিত। প্রতিটি ভবনের সামনে বিভিন্ন ফুল ও ফলের গাছ রয়েছে। নতুন ভবনের পেছনে ঘাট বাঁধানো একটি পুকুর আছে। পুকুরের চারপাশে রয়েছে গাছ। পুকুরের শীতল বাতাস বয়ে যায় ভবনটির ওপর দিয়ে। প্রতিটি ভবনের সামনে রয়েছে মাঠ। মাঠে ছাত্রছাত্রীদের জন্য দোলনা ও স্লিপারসহ খেলাধুলার জন্য বিভিন্ন সরঞ্জাম রয়েছে।
মাঠ থেকে একটু পেছনে গেলে দুই তলার একটি লাইব্রেরি চোখে পড়ে। লাইব্রেরিটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে দেখে মনে হবে যেন ডুপ্লেক্স কোনো বাড়ি।
মূল দরজা দিয়ে ঢুকতেই একটি দৃষ্টিনন্দন ভবন আপনাকে মুগ্ধ করবে। এই ভবনে জার্মান ও অস্ট্রিয়ার কয়েকজন শিক্ষক এবং আমাদের দেশের কয়েকজন শিক্ষক পরিবারসহ থাকেন।
মাটি, বাঁশ, খড়, দড়ি, বালি, সিমেন্ট ও কাঠসহ প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে বানানো আনন্দালয়ের স্থাপত্যশৈলী বৈচিত্র্যময় ও অপূর্ব। এটি নকশা করার জন্য সম্প্রতি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ওবেল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন বিখ্যাত জার্মান স্থপতি আন্না হেরিঙ্গার। একই উপকরণ দিয়ে গড়ে তোলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মেটি স্কুলের সুবাদে ২০০৭ সালে তিনি পেয়েছিলেন আগা খান আর্কিটেকচার অ্যাওয়ার্ড। পুরস্কার হিসেবে দীপশিখাকে ১৩ হাজার ৭০০ মার্কিন ডলার, আর্কিটেক্ট আন্না হেরিঙ্গারকে ১৬ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার ও আর্কিটেক্ট আইকে রোজওয়ার্গকে ৮ হাজার ২০০ ডলার দেওয়া।
চোখ জুড়ানো এ স্থাপনাটি দেখতে প্রতিদিন ভিড় জমান দেশ-বিদেশের অনেক পর্যটক। অনন্য এ স্থাপনটি দিনে দিনে পর্যটকদের আকর্ষণ করেই চলেছে। বর্তমানে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার ঘটাতে শিক্ষার্থীদেরে চিন্তার বিকাশ, ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টিতে দীপশিখার গুরুত্ব অপরিসীম। ভ্রমণপিপাসু আমরা প্রতিনিয়তই বিভিন্ন যায়গা ভ্রমণ করে থাকি। আমাদের দেশে অনেক দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য রয়েছে যেগুলোর তথ্য আমরা সেভাবে জানি না। তার মধ্যে অন্যতম এই দীপশিখা মেটি স্কুল।
যেভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে বাস ও ট্রেনে দিনাজপুর যাওয়া যায়। দিনাজপুর সদরে নেমে সেখান থেকে একটি অটোরিকশা রিজার্ভ করে চলে যেতে পারবেন রুদ্রাপুর গ্রামের দীপশিখা স্কুলে। এ ক্ষেত্রে অটোভাড়া নেবে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। চাইলে ভেঙে ভেঙেও যাওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে প্রথমে যেতে হবে কাঞ্চন ব্রিজ। সেখান থেকে বিরল মঙ্গলপুরে যেতে হবে। মঙ্গলপুর থেকে নেমে ফের একটি অটো নিয়ে যেতে হবে রুদ্রাপুর গ্রামে দীপশিখা স্কুলে।
কোথায় থাকবেন:
দিনাজপুর সদরে অনেক আবাসিক হোটেল রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হোটেল আফিয়া, হোটেল ইউনিক রেসিডেনসিয়াল, হোটেল আল রশিদ। এ ছাড়াও দিনাজপুর পর্যটন মোটেল, সার্কিট হাউজ, রামসাগর জাতীয় উদ্যান রেস্ট হাউজে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
কোথায় খাবেন:
খাওয়ার জন্য দিনাজপুর বিখ্যাত। দিনাজপুরে বাংলা, চাইনিজ ও ফাস্টফুড সব খাবারই পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে রুস্তুম হোটেলের গরুর মাংস-ভাত অথবা লক্ষ্মীপুরে হাঁসের মাংসের স্বাদ নেওয়া যেতে পারে।
অন্যান্য দর্শনীয় স্থান:
দিনাজপুর জেলার অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলো হলো রাজবাড়ি, নয়াবাদ মসজিদ, বড়মাঠ ঈদগাহ মিনার, রামসাগর দিঘি, সুখসাগর দিঘি ও কান্তজীর মন্দির অন্যতম।