ঢাকাসোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২

মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফেরার লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন তারা

নরসিংদী সংবাদদাতা, আরটিভি নিউজ

রোববার, ০৬ মার্চ ২০২২ , ০৮:২৫ এএম


loading/img
ফাইল ছবি

চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি লিবিয়া থেকে স্পিডবোটে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাচ্ছিলেন অভিবাসনপ্রত্যাশী ৩৫ জন বাংলাদেশি। ইতালি পৌঁছার ঘণ্টাখানেক আগে মাল্টা সীমানার জলরাশিতে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই স্পিডবোটটি উল্টে গেলে সব যাত্রী ডুবে যান। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় ভেসে থাকার ১১ ঘণ্টা পর কোস্টগার্ডের সদস্যরা উল্টে যাওয়া স্পিডবোটের ওপরে অবস্থান করা জীবিত সাতজনকে উদ্ধার করেন। তবে তীরে পৌঁছার আগেই ঠাণ্ডায় জমে একজনের মৃত্যু হয়। ঘটনার ৩৫ দিন পেরিয়ে গেলেও ভূমধ্যসাগরে এখনও নিখোঁজ আছেন ২৮ জন, তাদের মধ্যে ১৫ জনই নরসিংদীর।

বিজ্ঞাপন

সলিলসমাধির হাত থেকে বেঁচে ফেরা ছয়জনের মধ্যে দুজন গত বৃহস্পতিবার (৩ মার্চ) দেশে ফিরেছেন। তাদের একজন নরসিংদীর রায়পুরার মো. খোরশেদ মৃধার ছেলে ইউসুফ মৃধা (২৯) ও অন্যজন ফরিদপুরের নগরকান্দার মো. ইউনুস শেখের ছেলে শেখ সামিউল (১৮)। বর্তমানে এই দুজন রাজধানীর হাজি ক্যাম্পে হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন। তাদের মাধ্যমেই এতদিন পর ‘ওই দিন ঠিক কি ঘটেছিল’ তার বিস্তারিত জানতে পারেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা। 

গতকাল শুক্রবার বিকেলে এ বিষয়ে ইউসুফ মৃধা ও শেখ সামিউলের সঙ্গে মুঠোফোনে আরটিভি নিউজকে বলেন জানান, গত ২৭ জানুয়ারি লিবিয়ার স্থানীয় সময় রাত ৮টার দিকে দুই মিশরীয় চালক আমাদের ৩৫ জনকে নিয়ে ইতালির উদ্দেশে রওনা হন। ভূমধ্যসাগরে পাড়ি দেওয়ার সময় পড়ে যাওয়া একজনকে তুলতে গিয়ে স্পিডবোটটি উল্টে যায়। এরপর ওই প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পানিতে প্রায় ১১ ঘণ্টা ভেসে ছিলেন তারা। চোখের সামনে ১০ থেকে ১২ জনকে মারা যেতে দেখেছেন। কূল-কিনারাহীন সাগরে ঢেউয়ের ধাক্কায় এক এক করে ভেসে গেছেন তারা। তবে তারা মোট ছয়জন উল্টে যাওয়া স্পিডবোটের ওপরে অবস্থান করায় বেঁচে গেছেন। এতদিনেও নিখোঁজ ২৮ বাংলাদেশির কোনো সন্ধান না পাওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে, তাদের সবারই সলিল সমাধি হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

নিখোঁজদের মধ্যে নরসিংদীর ১৫ জনের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন, রায়পুরার ডৌকারচরের নাদিম সরকার (২২), আলমগীর সরকার (৩৫), আল-আমিন ফরাজী (৩৩), দক্ষিণ মির্জানগরের এস এম নাহিদ (২৫), আমিরগঞ্জের ইমরান মিয়া (২১), আশিস সূত্রধর (২১), সবুজ মিয়া (২৫), হাইরমারার শাওন মিয়া (২২) সেলিম মিয়া (২৪) ও বেলাব উপজেলার বেলাবর আল আমিন (২৮), নারায়ণপুরের মতিউর রহমান (৩৭), সল্লাবাদের শরীফুল ইসলাম (২৪), সালাউদ্দিন (৩২), মো. হালিম (২৬),  বিপ্লব মিয়া (২৪)। এ ছাড়া বাকি ১৩ জন ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গাজীপুর ও সিলেট জেলার বাসিন্দা।

রায়পুরার ডৌকারচরের নিখোঁজ তিন যুবকের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রায়পুরার আমিরগঞ্জের হাসনাবাদের তারেক মোল্লা নামের এক দালালের সঙ্গে যোগাযোগ হয় নাদিম, আল আমিন ও আলমগীরের। তিনমাস আগে ইতালি পর্যন্ত যাওয়ার জন্য সাড়ে ৮ লাখ টাকায় ওই দালালের সঙ্গে চুক্তি করেন তারা। সাড়ে ৬ লাখ টাকা করে তার হাতে দেওয়ার পর গত ২৭ ডিসেম্বর তারা ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা হন। প্রথমে তাদের দুবাই নিয়ে এক সপ্তাহ রাখা হয়। পরে মিশর হয়ে তাদের পাঠানো হয় লিবিয়ার বেনগাজী শহরে। সেখানে খাদ্য সংকটে আরও প্রায় ১০ দিন থাকার পর ব্যক্তিগত গাড়ির ডেকের ভেতরে ভরে দুই দিনের জার্নি শেষে তাদের নেওয়া হয় ত্রিপোলি শহরে। সেখানে তারা দেখা পান এই চক্রের মূল দালাল মনির চন্দ্র শীল নামের এক ব্যক্তির, যার বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরার আমিরগঞ্জের হাসনাবাদে। 
তারা আরও জানান, এই তিনজনসহ আরও অন্তত ২০ থেকে ২৫ জন দালাল মনির চন্দ্র শীলের বাড়িতে থাকেন আরও সাতদিন। সেখানে অবস্থানের সময়ই তারা জানতে পারেন বৈধভাবে ইতালি নেওয়ার কথা বলে দেশ থেকে তাদের নেওয়া হলেও এখন তাদের সেখানে পাঠানো হবে অবৈধভাবে। পরে তাদের কাছে গেমিংয়ের (লিবিয়া থেকে বোটে করে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে ইতালি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার নাম গেমিং) পরিকল্পনা জানানো হয়। 

তাদের জানানো হয়, ৩০০ সিসির দুইটি ইঞ্জিনের একটি স্পিডবোটে করে তাদের নেওয়া হবে। যার ধারণক্ষমতা অন্তত ৫০ জন। মোট ৪২ জনকে নিয়ে জোয়ারা ঘাটে গেলে দেখা যায় ওই স্পিডবোটটিতে ১৬০ সিসির একটি ইঞ্জিন রয়েছে, যার ধারণক্ষতা সর্বোচ্চ ২৫ জন। ২৫ জনের জায়গায় ৪২ জনকে উঠানো হলে চালক পাঁচজনকে নামিয়ে দেন। গত ২৭ জানুয়ারি স্থানীয় সময় রাত ৮টার দিকে মিশরীয় দুই চালক স্পিডবোটটিতে ৩৫ জন বাংলাদেশিকে নিয়ে ইতালির উদ্দেশে রওনা হন। 

বিজ্ঞাপন

বেঁচে ফেরা শেখ সামিউল জানান, ২৫ জনের ধারণক্ষমতার স্পিডবোটে আমরা ছিলাম ৩৫ জন। লাইফ জ্যাকেট বা কোনো ধরনের সেফটি ইকুইপমেন্ট আমাদের কাউকে দেওয়া হয়নি। লিবিয়ার থেকে রওনা হয়ে তিউনিশিয়া পার হয়ে মাল্টা জলসীমা অতিক্রম করার সময় আমাদের একজন চলন্ত স্পিডবোট থেকে সাগরে পড়ে যায়। তাকে এমন অবস্থায় রেখে আমরা চলে যাব, এটা আমাদের মনে সায় দেয়নি। পরে স্পিডবোট ঘুরিয়ে তাকে টেনে তোলার সময় এটি একদিকে কাত হয়ে যায়। এ সময় বিপরীত দিক থেকে আসা ঢেউয়ের ধাক্কায় স্পিডবোটটি উল্টে গেলে সব যাত্রী সাগরে ডুবে যান। আমাদের মধ্যে সাতজন কোনো রকমে উল্টে যাওয়া স্পিডবোটের ওপরে উঠতে পেরেছিলাম। এ সময় স্পিডবোট ধরে ভেসে ছিলেন অন্তত ১৫ জন। ভেসে থাকতে থাকতে বেশ কয়েকজনকে মারা যেতে দেখেছি। আবার অনেকে ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে গেছেন অনেক দূরে। ইতালি পৌঁছার আর মাত্র একঘণ্টার মত দূরত্ব বাকি ছিল।

বেঁচে ফেরা ইউসুফ মৃধা জানান, আমি একাই একজনের শার্টের কলার, আরেকজনের মাফলার ও দুই হাতে আরও দুইজনসহ মোট চারজনকে ভাসিয়ে রেখেছিলাম। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় এদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হলে আমি হাত ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। এভাবে এক এক করে কেউ ডুবে যাচ্ছিলেন, কেউ ভেসে যাচ্ছিলেন। নিজেরা বাঁচব নাকি অন্যদের বাঁচাব- এটা ভেবেই সময়গুলো একটা ঘোরের মধ্যে কাটছিল। একটা সময় বহুদূরে কোস্টগার্ডের একটি জাহাজ ভেসে যেতে দেখি। আমাদের মধ্যে একজনের লাল জামা পরা ছিল। তার জামা খুলে উড়াতে থাকি আমরা। পরে তারা এসে আমাদের সাতজনকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। উদ্ধার করে তীরে নেওয়ার পথেই রাশেদুলের মৃত্যু হয়। আমাদের ছয়জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর প্রায় একমাস জেলে রাখার পর স্থানীয় দূতাবাসের সহযোগিতায় আমাদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা হয়। বৃহস্পতিবার সকালে আমরা দুজন দেশে ফিরেছি। অন্য চারজনও দ্রুতই দেশে ফিরবেন।

নিখোঁজ ব্যক্তিদের কয়েকজন অভিভাবকরা আরটিভি নিউজকে জানিয়েছেন, ঘটনার পাঁচদিন পর গত ৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে একটি সংবাদমাধ্যমে প্রথম আলোতে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার সময় ঠাণ্ডায় জমে নরসিংদীর বেলাব উপজেলার মো. রাশেদুল ইসলাম নামের এক যুবকের মৃত্যুর খবর পাই আমরা। এদিকে সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগ না হওয়ায় সন্দেহবোধ থেকে নিহত রাশেদুলের ছবি স্পিডবোট থেকে নেমে যাওয়া ওই পাঁচজনের কাছে পাঠিয়ে জানতে চাওয়া হয়, রাশেদুল ও তাদের সন্তানরা একই স্পিডবোটে ছিল কি না? একই স্পিডবোটে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করলে আমরা চিন্তায় পড়ে যাই। গত একমাস ধরে আমরা তাদের কোনো খোঁজখবর পাচ্ছিলাম না তবে ছয়জন জীবিত উদ্ধারের পর জেলে থাকার খবর আমরা জানতে পারি। দূতাবাসের মাধ্যমে গতকাল সকালে তাদের মধ্যে দুজন দেশে ফিরলে আমরা বিমানবন্দরে গিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। পরে জানতে পারি স্পিডবোটটির দুই চালকসহ ৩০ জনই সাগরে ভেসে গেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাড়ে ৮ লাখ টাকায় বৈধভাবে প্লেনে করে ইতালি নিয়ে যাওয়ার চুক্তি দালালদের সঙ্গে হলেও, অবৈধভাবে সেখানে যাওয়ার বিষয়টি জানা যায় লিবিয়ায় অবস্থানের সময়। অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার ওই যাত্রায় নরসিংদী থেকেই ছিলেন অন্তত ২৪ জন। এখনও নিখোঁজ আছেন ১৫ জন। একজন বেঁচে ফিরেছেন, দুইজন ফেরার অপেক্ষায়, একজন মারা গেছেন, পাঁচজন এখনও লিবিয়ায় অবস্থান করছেন। 

নিখোঁজ নাদিম সরকারের বাবা সোবহান সরকার আরটিভি নিউজকে জানিয়েছেন, দালাল তারেক মোল্লার মাধ্যমেই রায়পুরার ১২ জনসহ বিভিন্ন জেলার অন্তত ২০-২৫ জন লোক ইতালি রওনা হয়েছিল। তিনি রায়পুরার আমিরগঞ্জের হাসনাবাদে বসে বৈধভাবে ইতালি নেওয়ার কথা বলে প্রলোভন দেখিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের লোকজনকে অবৈধভাবে বিদেশে পাঠান। তার ও মনির চন্দ্র শীলের মতো দালালদের প্রলোভনের ফাঁদে পড়েই আজ এতগুলো পরিবারে কান্নার রোল উঠেছে। তাদের কঠোর শাস্তি হলে এই ২৮ জনের আত্মা শান্তি পাবে। 

নরসিংদী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তাফা মিয়া এ বিষয়ে বলেন, মৃত্যুঝুঁকি থাকার পরও দালালদের মাধ্যমে অবৈধ পথে ইউরোপে যাওয়ার প্রবণতা কমছে না। উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও বিবেচনাবোধের অভাব থেকেই অনেক তরুণ-যুবক এত ঝুঁকি নেন। এসব উদাহরণ থেকেই শিক্ষা নিয়ে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।

জানতে চাইলে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান আরটিভি নিউজকে জানিয়েছেন, লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার জন্য যে দেশের নাগরিকরা সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করে সে তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সবসময়ই শীর্ষে। যে জেলাগুলো থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ এই ঝুঁকি নেয় তার মধ্যে নরসিংদী অন্যতম একটি। গত এক দশকে এ পথে কমপক্ষে ৬৫ হাজার বাংলাদেশি শুধু আটকই হয়েছেন। প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত পাঁচশতাধিক মানুষ। অথচ যে পরিমান টাকা দিয়ে তারা এমন ঝুঁকি নেন, এ দিয়ে কিন্তু তারা নিজেদের এলাকাতেই কিছু করতে পারেন। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক দালালদের চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিলে এই প্রবণতা কমবে না। 

নরসিংদীর জেলা প্রশাসক আবু নইম মোহাম্মদ মারুফ খান জানান, জেলার ১৫ জনসহ মোট ২৮ জন বাংলাদেশি ভূমধ্যসাগরে ৩৫ দিন ধরে নিখোঁজ থাকার বিষয়টি শুনেছি। এছাড়া নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের কোন সদস্যও আমাদের এ বিষয়ে কিছু জানাননি। এ বিষয়ে কতটুকু কি করা সম্ভব, তা খোঁজ নিয়ে দেখা হবে। স্থানীয় দালালদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জেলা প্রশাসক আরও জানান, অভিবাসন প্রত্যাশী ব্যক্তিদের কাছে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার জন্য আমাদের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক রয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা বিদেশগামী ব্যক্তিদের বিভিন্ন ধরনের সেবা দিয়ে থাকি। এ ক্ষেত্রে আমার অনুরোধ থাকবে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা না করে, ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে যেন সবাই বিদেশগামী হন। তাহলে আর কোন মায়ের বুক এভাবে খালি হতে হবে না।

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন

Loading...


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |