• ঢাকা রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১
logo

চিকিৎসক ছাড়াই তৈরি হয় ভুয়া সনদ, নিয়ন্ত্রণে ‘ব্রাদার’ মিজানুর

রাজশাহী প্রতিনিধি, আরটিভি নিউজ

  ০৫ জুলাই ২০২৪, ১৭:২৪
ছবি : আরটিভি

নেই কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নেই টেকনিশিয়ান ও আধুনিক যন্ত্রপাতি। যে দু-একটি রোগ পরীক্ষার চিকিৎসা যন্ত্র রয়েছে সেটি চালানোর মতো লোকবল নেই। তারপরও প্যাথলজি বিশেষজ্ঞের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে চলছে রাজশাহীর কাজিহাটা এলাকার লক্ষ্মীপুর মোড়ে অবস্থিত অনুমোদনহীন নিউ রাজশাহী স্কয়ার ডায়াগনস্টিক কনসালটেশন সেন্টারে চিকিৎসা সনদ জালিয়াতির রমরমা ব্যবসা।

এতে করে ভুয়া পরীক্ষায় রোগীরা যেমন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে। পাশাপাশি এই ভুয়া পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয়ের নামে প্রতারণার মাধ্যমে রোগীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে অনুমোদনহীন এই ডায়াগনস্টিকের চক্রটি। আর এসব কাণ্ডের মূল হোতা হিসেবে নাম উঠে এসেছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৪২ নং ওয়ার্ডের কর্মরত (ব্রাদার) মিজানুর রহমান মিজানের নাম।

তিনি এই ডায়গনস্টিক সেন্টারটি চালিয়ে আসছেন কখনও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কখনও রামেক হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স, কখনও আবার রামেক হাসপাতালের ৪২নং ওয়ার্ডের (ওটি) সার্জারি ইনচার্জ পরিচয় দিয়ে। শুধু তাই নয় এই মিজান রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দালাল সিন্ডিকেটের অন্যতম নিয়ন্ত্রক বলে অভিযোগ রয়েছে। যার সত্যতার প্রমাণ মিলেছে এরই মধ্যে।

গত ২৮ জুলাই রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভেতরের ১৫নং ওয়ার্ড থেকে সন্ধ্যায় নিউ রাজশাহী স্কায়র ডায়াগনস্টিক কনসালটেশন সেন্টারের তিন নারী দালালকে আটক করে হাসপাতালের কর্মরত আনসার সদস্যরা। এ সময় তাদের ছাড়াতে তাৎক্ষণিক হাসপাতালে ছুটে যান ব্রাদার মিজানুর রহমান। পরে তিনি হাসপাতালে মুচলেকা দিয়ে ওই তিন নারী দালাল সদস্যকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের বেশ কয়েকজন জানান, মিজান দীর্ঘদিন ধরে এই হাসপাতালে রয়েছে। তিনি সরকারি চাকরি করলেও সে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রয়েছে। যেটি সরকারি চাকরির আইন অনুযায়ী পরিপন্থী।

তারা আরও বলেন, দীর্ঘ সময় চাকরির সুবাদে হাসপাতালের দালালদের সঙ্গে মিজানের বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে ১৩, ১৫ ও ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে প্রতিদিনই মিজান এই দালাল সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে। এরপর তিনি নিউ রাজশাহী স্কয়ার ডায়োগনেস্টিক কনসাল্টেশন সেন্টারে রোগীর পরীক্ষা নিরীক্ষা করানোর জন্য তার প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে থাকেন।

মিজানের এমন ঘটনার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে বেশ কয়েকবার ডেকে মৌখিকভাবে সতর্ক করেন। তাতেও কোনো লাভ হয়নি। বরং প্রতিনিয়তই দালাল সিন্ডিকেট নেটওয়ার্ক শক্ত করে গড়ে তুলেছেন এই মিজান।

অনুসন্ধান দেখা যায়, গত ২৮ জুলাই রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আয়েশা বেগম নামে ১৫ নং ওয়ার্ডে এক বয়স্ক নারী রোগীর রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সেই রোগীকে চিকিৎসক ইলেক্ট্রোলাইট ও সিভিসি পরীক্ষা করতে দেন। এরপর সেই নমুনাটি নিউ রাজশাহী স্কয়ার ডায়াগনস্টিক কনসালটেশন সেন্টারে পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়। মাত্র ১ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ওই রোগীর দুটি পরীক্ষার সনদ দেয় নিউ রাজশাহী নিউ স্কয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার। আর সেই সনদটি তৈরি করা হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের (অব.) সহকারী অধ্যাপক ডা. ইরফান রেজার নামে। অথচ (অব.) এই অধ্যাপক তিনি নিজেও জানেন না তার স্বাক্ষর জাল করে তৈরি করা হয়েছে ভুয়া সনদ।

জানতে চাইলে ডা. ইরফান রেজা বলেন, গত ২৮ তারিখ রাতে আমি ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যায়নি। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন সনদে ব্যবহারকৃত স্বাক্ষরটি তার নই।

তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। তবে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি না? এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি, বিষয়টি এড়িয়ে যান। পরে কল দেওয়া হলে তিনি আর ফোন রিসিভ করেননি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রামেক হাসপাতালে ব্রাদার মিজান, তিনি স্কয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি চালান। যেখানে ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান তার পিতা জয়নাল হোসেন। মিজানের পিতা জয়নাল পেশায় একজন মুয়াজ্জিন। তিনি বগুড়া জেলার মাগুরা গ্রামে থাকেন।

মুয়াজ্জিনের পাশাপাশি তিনি কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে নিউ রাজশাহী ডায়গনস্টিক সেন্টারে চেয়ারম্যান হিসেবে জয়নাল হোসেনের নাম উল্লেখ থাকলেও কখনওই তিনি এই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পা রাখেননি। ফলে মিজানই এই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সব কিছু দেখভাল করেন। এরই সুযোগ নাম সর্বস্ব ও অনুমোদনহীন ডায়গনস্টিক সেন্টারের নামে অনেকের কাছ থেকে মিজান শেয়ারের নামে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা।

যাদের বেশির ভাগই নার্সিং কলেজের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থী। তেমন একজন একসময়ের মিজানের ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবসায়িক পার্টনার (ছদ্মনাম) বাহার উদ্দিন। তার সাথে মিজানের একটি কাগজে ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অংশীদারিত্বের চুক্তি পত্র আরটিভি নিউজের হাতে এসে পৌঁছিয়েছে। যেখানে খোঁদ মিজান দাবি করছেন নিজেকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে।

এদিকে, নিউ রাজশাহী স্কয়ার ডায়াগনস্টিক কনসালটেশন সেন্টারের অনুমোদন নিতে বেশ দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন মিজান। এরইমধ্যে তিনি স্বাস্থ্য বিভাগে একটি আবেদনপত্রে তার ইমেইল এবং ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বারটি ব্যবহার করেছেন। সেই ফরমের রেজিস্ট্রেশন নাম্বারটি হচ্ছে (এইচ এস এম ৮০২৫৩) যেখানে প্রতিষ্ঠানের ধরন তিনি উল্লেখ করেছেন (বি) ক্যাটাগরিতে। কিন্তু আবেদনটিতে চেয়ারম্যান হিসেবে দেখানো হয়েছে বাবা জয়নাল হোসেনকে।

চুক্তিপত্রের ব্যাপারে মিজানের সাবেক ব্যবসায়ী পার্টনার বাহার উদ্দিন (ছদ্মনাম) জানান, মিজানের একের পর এক প্রতারণা যখন, আমাদের সামনে আসতে থাকে, তখন সিদ্ধান্ত নিই, তার এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্ব ছিন্ন করার। প্রথমে লিখিত কাগজের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা এবং কোন ডকুমেন্ট ছাড়া আরও ৫০ হাজার টাকাসহ মোট ১ লাখ টাকা দিয়ে ১ শতাংশ মিজানের কাছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারটির অংশীদারিত্ব নিয়েছিলাম। এখন সেই টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে মিজান নানান টালবাহানা শুরু করেছে।

এ বিষয়ে নিউ রাজশাহী স্কয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চেয়ারম্যান জয়নাল হোসেনের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করতে চাইলে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে অভিযুক্ত (ব্রাদার) মিজানুর রহমান মিজান জানান, এরই মধ্যে আমি ওই প্রতিষ্ঠানকে ইস্তফা দিয়েছি। ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই।

সরকারি চাকরি করে কীভাবে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হন সে প্রশ্নের জবাবে মিজান বলেন, বিষয়টি আমার ভুল হয়েছে, সেটি আমি বুঝতে পেরেছি। তাই ইস্তফা দিয়েছি। আর যাদের সাথে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের শেয়ারের নামে টাকা নেওয়া হয়েছে, সেই টাকা অল্প সময়ের মধ্যে ফেরত দেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহাম্মদ জানান, এরই মধ্যে হাসপাতালের ব্রাদার মিজানের বেশ কিছু অভিযোগ সম্পর্কে আমরা ইতোমধ্যে অবগত হয়েছি। অনুসন্ধান করে তার বিরুদ্ধে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক আনোয়ারুল কবির আরটিভি নিউজকে জানান, নিউ স্কয়ার রাজশাহী ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কোনো অনুমোদন নেই। তবে তারা অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছে। যদি সত্যি তারা এমন অনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে থাকে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মন্তব্য করুন

Radhuni
  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
রাজশাহীতে গণপিটুনিতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নিহত  
রাজশাহীতে চিকিৎসক বুলবুলের বিচার দাবিতে মানববন্ধন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চার হলে নতুন প্রাধ্যক্ষ নিয়োগ
রাবির ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের যোগদান