উচ্চহারে সুদ দেওয়ার প্রলোভনে জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলায় সমবায় সমিতির প্রায় ৩৫ হাজার গ্রাহকের ৭০০ কোটি টাকা সঞ্চয়ের নামে জমা রেখে লোপাট করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত সমিতিগুলোর মালিক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে থানায় ছয়টি মামলা দায়ের হলেও তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বিগত সরকারের সময়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও স্থানীয় সংসদ সদস্য মির্জা আজমের মদদে পরিচালিত হয়েছে এসব সমবায় সমিতি। কিন্তু রহস্যজনক কারণে স্থানীয় প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকের টাকা উদ্ধারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।
জেলা সমবায় কার্যালয়ের সূত্র জানায়, প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী ভুক্তভোগী গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার। এর মধ্যে বেশির ভাগ গ্রাহক মাদারগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা। তাদের মধ্যে পোশাকশ্রমিক, প্রবাসী ও তাদের স্ত্রী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কৃষক, গৃহকর্মী, দিনমজুর ও চাকরিজীবীরাও আছেন। এসব গ্রাহকের প্রায় ৭৩০ কোটি টাকা সমিতিগুলোর কাছে সঞ্চয় ছিল। তবে, ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের দাবি—টাকার পরিমাণ প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি।
সূত্রটি আরও জানায়, মাদারগঞ্জ উপজেলায় ১৬৩টি সমবায় সমিতির নিবন্ধন দেওয়া আছে। এর মধ্যে ২০২২ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন কারণে ৭৪টি সমিতির কার্যক্রম প্রায় বন্ধের পথে। ইতোমধ্যে জেলা সমবায় কার্যালয় ২৩টি সমিতিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই সমিতিগুলো হলো—আল-আকাবা, শতদল, স্বদেশ, হলি টার্গেট, নবদীপ, রংধনু, আল-আকসা, পরশমণি, স্বপ্ন তরী, মাদারগঞ্জ সেবা, আশার আলো, রূপালী বাংলা, শ্যামল বাংলা, জনকল্যাণ, মাতৃভূমি কৃষি উন্নয়ন, দারিদ্র্যবিমোচন, মিতালী কৃষি উন্নয়ন, স্বাধীন বাংলা কৃষি, অগ্রগামী কৃষি উন্নয়ন, আমানত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দারিদ্র্য শ্রমজীবী, আল ইনসাফ শ্রমজীবী ও জনতা শ্রমজীবী। এগুলোর মধ্যে আল-আকাবা, শতদল, স্বদেশ, নবদীপ, হলি টার্গেট ও রংধনু সমিতির কাছে জমা আছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার বেশি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার শিক্ষক দম্পতি মো. রেজাউল মাসুদ ও মনোয়ারা বেগম চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর ৫৬ লাখ টাকা পার্শ্ববর্তী মাদারগঞ্জ উপজেলার আল-আকাবা সমবায় সমিতি লিমিটেড নামের একটি সংস্থায় জমা রাখেন। কিন্তু ২০২২ সালের শেষের দিকে এই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে আত্মগোপনে চলে যান উদ্যোক্তারা। এই খবরে সারা জীবনের কষ্টে জমানো এই সঞ্চয় নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে রেজাউল মাসুদ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর টাকার অভাবে এক রকম বিনা চিকিৎসায় গত বছরের ১৭ মে তিনি মারা যান।
মনোয়ারা বেগম জানান, ‘লোভে পড়ে ওই সমিতিতে আমার স্বামী নিজ নামে ৪৫ লাখ ৭১ হাজার এবং আমার নামে ৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা সঞ্চয় করেছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন জানতে পারি, সমিতির লোকজন সব বন্ধ করে চলে গেছেন। এই খবরে আমার স্বামী আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। টাকার অভাবে তার চিকিৎসাও করাতে পারছিলাম না। সমিতির লোকজনের সঙ্গে অনেক যোগাযোগ করেছি, কিন্তু তাদের আর পাইনি। ফলে একরকম বিনা চিকিৎসায় আমার স্বামী মারা গেছেন। আমরা একদম পথে বসে গেছি।’
একই ধরনের পরিনতির শিকার হয়েছেন স্থানীয় আবদুল হামিদ ও সবর আলী নামে আরও দুই গ্রাহক। তারাও টাকার দুঃশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন গত ২ বছরে। এছাড়াও টাকার শোকে স্টোক করে শয্যাশায়ী হয়ে আর্থিক সংকটে দিন কাটাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দা মো. শাহীন মিয়া, শাহনাজ পারভীন, আক্তারুন্নেসা, সুজা মিয়া ও রাকিবা সুলতানার মত আরও অনেকেই।
ভুক্তভোগী মো. আকতারুজ্জামান জানান, আমার স্ত্রী তাসলিমা ১ কোটি ১২ লাখ টাকা আল-আকাবা নামক সমবায় সমিতিতে জমা রেখেছিলেন। মির্জা আজমের চাচাতো ভাই জামায়াত নেতা মির্জা মাজেদ ও মির্জা আজমের স্ত্রী এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতেন। তার সঙ্গে ছিলেন জামায়াত নেতা হুমায়ান আহম্মেদসহ আরও কয়েকজন। আমরা তাদের প্রতি বিশ্বাস রেখে টাকা জমা রেখেছিলাম। এখন তারা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে পালিয়েছে। বিষয়টি জেলা ও উপজেলা জামায়াতের নেতাদের জানানো হয়েছে। তারা বলছে- তাদেরকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে। কিন্তু আমাদের বিষয়টি তারা দেখছে না।
একইভাবে যুবলীগ নেতা ও শতদল বহুমুখী সমবায় সমিতির পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক আ. বাছেদ, স্বদেশ বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি উপজেলা যুবলীগের সদস্য আনিছুর রহমান ও এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক আ. হামিদ পৌর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং নবদীপ সমবায় সমিতির সভাপতি সাবেক ছাত্রদল নেতা ইব্রাহিম খলিল গ্রাহকদের কয়েত শত কোটি টাকা লোপাট করে দীর্ঘদিন ধরে আত্মগোপনে রয়েছেন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
জানতে চাইলে জেলা জামায়াতের আমির মাওলানা মো. আব্দুস সাত্তার বলেন, এটি জামায়াতের কোন প্রতিষ্ঠান না, তবে যারা এটি পরিচালনা করতো তারা জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। তারা আমাদের দলের ইমেজকে ব্যবহার করে এই কাজ করেছে। তাই আমরা বিষয়টি জানার পর জনগণের টাকা জনগণকে ফেরত দিতে তাদের সর্তক করেছি। এরই মাঝে তারা ৩ জন দল থেকে পদত্যাগ করেছে, এই দায় তাদের।
এদিকে, সম্প্রতি এসব টাকা উদ্ধারে আন্দোলনে নেমেছে ভুক্তভোগীরা। ইতোমধ্যে আন্দোলনকারীরা উপজেলা প্রশাসনের কার্যালয় ঘেরাওসহ জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সঙ্গে দেখা করে নানা কর্মসূচি পালন করেছে। কিন্তু ভুক্তভোগীদের টাকা উদ্ধারে এখনো কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিবলুল বারি রাজু।
তিনি বলেন, বিগত সময়ে স্থানীয় প্রশাসন ছিল মালিক পক্ষের। তবে বর্তমানে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে স্থানীয় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনক আমাদের নিয়ে একাধিকবার আলোচনা করে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহনের আশ্বাস দিয়েছে।
ভুক্তভোগীরা আরও জানান, এসব ঘটনায় থানা ও প্রশাসনে অসংখ্য অভিযোগ ও মামলা দায়ের হয়েছে। কিন্তু এ ঘটনায় জড়িত মূলহোতারা সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
খবরের সত্যতা নিশ্চিত করে জামালপুর জেলা সমবায় কর্মকর্তা মো. আবদুল হান্নান বলেন, ভুক্তভোগীদের সঙ্গে স্থানীয় ডিসি-এসপির সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন বিষয়টি নিয়ে। তবে কার্যকর পদেক্ষেপের একটু সময় লাগবে। এতে আইনগতভাবে আমাদের কিছু করার নেই।
এসব ঘটনায় বিগত সময়ে মাদারগঞ্জ থানায় ৬টি মামলা দায়ের হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসান আল মামুন। তিনি বলেন, ৬টি মামলাতেই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এখন আদালত বিষয়টি দেখবে। তবে এর আগে এসব মামলায় ৩ জন এবং সম্প্রতি আরও ১ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
এসব বিষয়ে ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার (এসপি) সৈয়দ রফিকুল ইসলাম বলেন, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি নিয়ে সমন্বতি উদ্যোগ গ্রহণ করে কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫ জন আইনজীবীর সমন্বয়ে একটি কমিটি করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বেশি লাভের লোভে গ্রাহকরা এসব প্রতিষ্ঠানে টাকা রেখে এখন বিপাকে পড়েছে। ওই টাকায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সম্পদ বানিয়েছে। বিগত সময়ে এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিরা জড়িত ছিল। এখন তারা সবাই পলাতক।
তবে এসব বিষয়ে জানতে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সংশ্লিষ্ট সমিতির মালিকদের ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বরগুলোও বন্ধ পাওয়া গেছে। ফলে গ্রাহকের টাকা লোপাট করে পালিয়ে থাকার বিষয়ে তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
আরটিভি/কেএইচ