এবারের নববর্ষের আনন্দ শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে তৈরি ‘ফ্যাসিবাদী প্রতিকৃতি’ এর উচ্চতা ছিল প্রায় ২০ ফুট। যাতে ব্যবহার হয়েছে বাঁশ-বেত। মোটিফে বাঁশ ও বেত দিয়ে দাঁতাল মুখের এক নারীর মুখাবয়ব বানানো হয়। মাথায় খাঁড়া চারটি শিং, হাঁ করা মুখ, বিশালাকৃতির নাক ও ভয়ার্ত দুটি চোখ। এটিকে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি হিসেবে ধারণা করেছিলেন অনেকে।
‘ফ্যাসিবাদী প্রতিকৃতি’ এর বাইরেও কয়েকটি মোটিফ ছিল একই কারুকাজের। যা দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে অল্প অল্প করে ফুটে উঠেছে আসল রূপ। তবে একদিনেই সব শেষ করে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদে রাখা মোটিফটি রাতের অন্ধকারে আগুনে পুড়ে দেওয়া হয়েছে। এ আগুনে অন্যান্য মোটিফ টিকে থাকলেও পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়েছে ‘ফ্যাসিবাদী প্রতিকৃতি’। পাশে থাকা শান্তির প্রতীক পায়রাটি আগুনে একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর বাঘ আকৃতির প্রতিকৃতিটির লেজের দিকে কিছুটা পুড়ে গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ভোরে আগুন লেগেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে আজ সকালে চারুকলা অনুষদ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, নববর্ষের শোভাযাত্রা উপলক্ষে বানানো ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতির মোটিফটি কে বা কারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। এ জন্য তারা দুঃখ প্রকাশ করেছে।
এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ডিএমপির রমনা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) আব্দুল্লাহ আল মামুন গণমাধ্যমকে জানান, এই মুহূর্তে তারা ঘটনাস্থলে রয়েছেন। আশপাশের অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এ ছাড়া ঘটনাস্থল ও আশপাশের একাধিক সিসি ক্যামেরার ডিভিআর সংগ্রহের কাজ চলছে। ডিভিআরগুলো থেকে ফুটেজ দেখে জড়িতদের শনাক্ত করা হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর অভিযোগ, হাসিনার দোসররা ভোর রাতে চারুকলায় ফ্যাসিবাদের মুখাবয়ব পুড়িয়ে দিয়েছে। এই দুঃসাহস যারা দেখিয়েছে, সফট আওয়ামী লীগ হোক বা আওয়ামী বি টিম হোক- তাদের প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আসতে হবে, দ্রুত।
তিনি আরও বলেন, এই শোভাযাত্রা থামানোর চেষ্টায় আওয়ামী লীগের হয়ে যারা কাজ করছে, আমরা শুধু তাদেরকে আইনের আওতায় আনব তা নয়। আমরা নিশ্চিত করতে চাই, এবারের শোভাযাত্রা যেন আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়।
সংস্কৃতি উপদেষ্টা বলেন, কালকে রাতের ঘটনার পর হাসিনার দোসররা জানিয়ে দিয়ে গেলো, বাংলাদেশের মানুষ এক হয়ে উৎসব করুক তারা এটা চায় না। আমরা এখন আরও বেশি ডিটারমাইনড এবং আরও বেশি সংখ্যায় অংশ নেব।
তিনি বলেন, গত কিছুদিন জুলাই আন্দোলনের পক্ষের অনেকেই বলেছিলেন, এবারের শোভাযাত্রা সবচেয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ভিন্ন রকমের হচ্ছে। এখানে ফ্যাসিবাদের ওই বিকট মুখ না রাখাই ভালো। আমরাও সব রকম মত নিয়েই ভাবছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মত জানার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কালকের ঘটনার পর এই দানবের উপস্থিতি আরও অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল।
সবশেষে ফারুকী লিখেছেন, জুলাই চলমান।
তবে আর মাত্র দুই দিন বাকি। এই সময়ে এমন একটি মোটিফ তৈরি করা যায় কিনা সেই ভাবনা চলছে। তবে অনেকে সম্ভব মনে করলেও চারুকলার সাবেক শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান বলেন, আমরা গত একমাস ধরে এই প্রতিকৃতিটি তৈরি করতে কাজ করে আসছি। আমাদের ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছিল। এই ধরনের প্রতিকৃতি ২/১ দিনে তৈরি করা যায় না।
আসার কথা হচ্ছে মোটিফটিতে আগুন দেওয়ার ঘটনাটি ধরা পড়েছে সিসিটিভি ফুটেজে।
ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মুখে কালো মাস্ক পরা একজন মূল মোটিফে আগুন দিয়েছেন।
শনিবার (১২ এপ্রিল) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইসরাফিল রতন এসব তথ্য জানান।
তিনি জানান, ওই ব্যক্তির পরনে ছিল জিন্স, মুখে কালো মাস্ক। তিনি ঠাণ্ডা মাথায় মোটিফটিতে আগুন দেন। তবে তার পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি।
চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম চঞ্চল জানান, ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতিকে টার্গেট করে আগুন লাগানো হয়েছে। ওই আকৃতি পুরোটাই পুড়ে গেছে। একইসঙ্গে পায়রার অবয়বটাও পুড়ে গেছে। আনুমানিক রাত ৪টা থেকে সাড়ে ৪টার মধ্যে আগুন লাগানো হয়েছে।
চারুকলার এক শিক্ষার্থী বলেন, এটি নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ হয়েছিল। আজকের মধ্যে এটির কাজ শেষ হয়ে যেত। এটা নিঃসন্দেহে ষড়যন্ত্র। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি কেউ ইচ্ছা করেই আগুন লাগিয়েছে। প্রশাসনের লোকজনও এর পেছনে জড়িত কি না খুঁজে বের করতে হবে। কারণ, রাতে এখানে পুলিশের লোকজনও উপস্থিত ছিল।
আরটিভি/এএইচ