ইরানের রাজধানী তেহরানসহ দেশটির সামরিক স্থাপনা, পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রসহ বিভিন্ন স্থাপনায় গত ১২ জুন দিনগত রাতে হামলা চালায় ইসরায়েল, যা এখন চলমান রয়েছে। অপরদিকে পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে পরদিন ইসরায়েলের রাজধানী জেরুজালেম ও গুরুত্বপূর্ণ শহর তেল আবিবসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চলায় ইরান। উভয় পক্ষের এই সংঘাত বিশ্বজুড়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ভাষ্যমতে, ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার কারণে এই হামলা চালানো হচ্ছে। হামলাগুলোও পারমাণবিক কর্মসূচির মূল কেন্দ্র লক্ষ্য করে চালানো হচ্ছে।
২০১৫ সালে ছয় প্রভাবশালী দেশ ও ইইউ’র সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি হয়। চুক্তিতে ইরানকে পারমাণবিক কার্যক্রম সীমিত রাখার শর্ত দেওয়া হয়। বিনিময়ে দেশটির ওপর থেকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে চুক্তি থেকে তার দেশকে প্রত্যাহার করে নেন। এরপর থেকে ইরান পারমাণবিক কর্মসূচিতে ফের জোরদার করে। বর্তমানে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম মজুতের খুব কাছাকাছি ইরান।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানায়, ইরানের কাছে বর্তমানে যে পরিমাণ অস্ত্র তৈরির উপযোগী ইউরেনিয়াম রয়েছে, আরও কিছু পরিশোধন করলে তা দিয়ে দেশটি প্রায় ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারবে। যদিও, ইরান বরাবরই এ কথা অস্বীকার করে আসছে।
নিচে ইরানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনার তালিকা দেওয়া হলো, যেগুলো জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক দল নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছে।
ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র
নাতাঞ্জ
তেহরান থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত নাতাঞ্জ ইরানের মূল ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র। এটি গভীরভাবে সুরক্ষিত (বাংকারযুক্ত) একটি স্থাপনা। কেন্দ্রটির অস্তিত্ব প্রথম সামনে আসে ২০০২ সালে। নাতাঞ্জের দুটি সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রে প্রায় ৭০টি সেন্ট্রিফিউজের সারি আছে। এরমধ্যে একটি কেন্দ্রের কার্যক্রম ভূগর্ভে পরিচালিত হয়। সেন্ট্রিফিউজ হলো এমন যন্ত্র, যা ব্যবহার করে ধাপে ধাপে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা হয়।
২০২১ সালের এপ্রিলে নাতাঞ্জ পারমাণবিক কর্মসূচি কেন্দ্রে একটি হামলা হয়। এ হামলার জন্য ইসরাইলকে দায়ী করে ইরান। শুক্রবার (১৩ জুন) ভোরে এই কেন্দ্রে হামলা চালায় ইসরাইলি সেনাবাহিনী। কেন্দ্রটির পাশাপাশি সেখানে অবস্থানরত পরমাণুবিজ্ঞানীদেরও নিশানা করা হয়।
ফোর্দো
মধ্য ইরানের পবিত্র শহর কোমের কাছে একটি পাহাড়ের নিচে গোপনে নির্মিত পারমাণবিক কর্মসূচি কেন্দ্র ফোর্দো ২০০৯ সালে প্রথম প্রকাশ্যে আসে। এটি জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে তৈরি করা হয়। প্রাথমিকভাবে এটিকে ‘জরুরি’ স্থাপনা হিসেবে বর্ণনা করা হলেও পরে ইরান জানায়, এটি একটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র। সম্ভাব্য বিমান হামলা থেকে রক্ষার জন্য মাটির নিচে এটি নির্মাণ করা হয়। এই কেন্দ্রে প্রায় ৩ হাজার সেন্ট্রিফিউজ বসানো সম্ভব।
২০২৩ সালে এই কেন্দ্রে ৮৩ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের কণা পাওয়া যায়। ইরানের দাবি, পরিশোধন প্রক্রিয়ায় অনিচ্ছাকৃত তারতম্যের কারণে এমনটি হয়েছে।
ইউরেনিয়াম রূপান্তর ও গবেষণা চুল্লি
ইস্পাহান
মধ্য ইরানের ইস্পাহান শহরে অবস্থিত এই ইউরেনিয়াম রূপান্তর কেন্দ্রে খনি থেকে উত্তোলিত অপরিশোধিত ইউরেনিয়ামকে ইউরেনিয়াম টেট্রাফ্লোরাইডে (ইউএফ৪) রূপান্তর করা হয়। এরপর সেটিকে রূপ দেওয়া হয় ফ্লোরাইডে (ইউএফ৬)। আর এটিকে সেন্ট্রিফিউজে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কাজে ব্যবহার করা হয়।
২০০৪ সালে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর এই কেন্দ্রে শিল্পপর্যায়ে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালানো হয়। ইস্পাহান কেন্দ্রটিতে একটি পারমাণবিক জ্বালানি প্রস্তুতকারক কারখানাও রয়েছে, যা ২০০৯ সালে উদ্বোধন করা হয়। এখানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য স্বল্প সমৃদ্ধ জ্বালানি উৎপাদন করা হয়। ২০২২ সালের জুলাইয়ে ইরান ঘোষণা দেয়, তারা ইস্পাহানে একটি নতুন গবেষণা চুল্লি (রিঅ্যাক্টর) নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে।
আরাক
২০০০-এর দশকে খোন্দাব গ্রামের উপকণ্ঠে আরাক হেভি ওয়াটার গবেষণা চুল্লি নির্মাণের কাজ শুরু করে ইরান। তবে ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তির শর্তের কারণে এই প্রকল্পের কাজ পরে স্থগিত করা হয়। তবে, ইরান আইএইএ-কে জানিয়েছে, তারা ২০২৬ সালের মধ্যে চুল্লিটি চালু করার পরিকল্পনা করছে।
এই গবেষণা চুল্লিটি মূলত চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণার জন্য প্লুটোনিয়াম উৎপাদনের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল। এ ছাড়া সেখানে ‘হেভি ওয়াটার’ উৎপাদনের একটি কেন্দ্রও রয়েছে।
তেহরান
তেহরান পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রে একটি চুল্লি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬৭ সালে চিকিৎসাবিষয়ক রেডিও আইসোটোপ উৎপাদনের জন্য এটি ইরানকে সরবরাহ করেছিল।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
বুশেহর
দক্ষিণ ইরানের বন্দরনগরী বুশেহরে অবস্থিত দেশটির একমাত্র পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি রাশিয়া নির্মাণ করেছে। এটি ২০১১ সালে আংশিকভাবে চালু হয় এবং ২০১২ সালে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়। রাশিয়া এখনও এই কেন্দ্রের জন্য পারমাণবিক জ্বালানি সরবরাহ করে এবং কেন্দ্রটি আইএইএ-এর তত্ত্বাবধানে রয়েছে। প্রথমে একটি জার্মান কোম্পানি এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এই প্রকল্প নির্মাণ শুরু করেছিল। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর এটির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরে মস্কো এটি সম্পন্ন করে।
দারখোভিন ও সিরিক
২০২২ সালের শেষ দিকে ইরান দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় দারখোভিনে ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরু করে। ২০২৪ সালের শুরুতে তারা হরমুজ প্রণালির সিরিকে পাঁচ হাজার মেগাওয়াটের সম্মিলিত সক্ষমতার চারটি পৃথক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু করে।
আরটিভি/আরএ