‘পোলাপাইনগুলা না খাইয়া ছিল। খাওনের হোটেলগুলাও বন্ধ। অরা তো আমাগোই মাইয়া-পোলা। চোহের সামনে না খাইয়া আছে দেইখ্যা চাইরডা ভাত-তরকারি রাইন্ধা খাওয়াইছিলাম। হেইডাই এহন দোষ অইছে। মোগো পুলিশে খোঁজে। বাড়িও গ্যাছেলে কয়েকবার। হেইয়ার লাইগ্যা অহন পলাইয়া পলাইয়া থাহি।’ মোবাইল ফোনে কথাগুলো বলছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব এক মমতাময়ী মা। তার বাড়ি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) পাশেই।
নিরাপত্তার স্বার্থে নাম-পরিচয় গোপন রাখা এই মা জানালেন, তিনি ও তার পরিবারের ওপর পুলিশি হয়রানির কথা।
কোটা আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন দেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হলেও হল ছাড়েনি ববির শিক্ষার্থীরা। কারফিউ জারির আগ পর্যন্ত তারা আন্দোলন আর রাজপথ দখলে রেখেছিল। আন্দোলনের সেই দুঃসময়ে বাড়ি থেকে রান্না করে অভুক্ত শিক্ষার্থীদের খাইয়েছিলেন এই মা। আর সেটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই অমার্জনীয় অপরাধে এখন তাকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে!
কেবল এই মাই নন, ববির আশপাশের অনেক পরিবার আর ছোটখাটো ব্যবসায়ীদের এখন পোহাতে হচ্ছে পুলিশি হয়রানি আর ধরপাকড়ের দুর্ভোগ। কেউ কেউ আবার পুলিশকে ম্যানেজ করে হয়রানি থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করছেন। সবার একটাই অপরাধ, বন্ধের দিনগুলোতে আবাসিক হলে থাকা শিক্ষার্থীদের সহায়তা করেছিলেন, অভুক্তদের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছিলেন।
মহাসড়ক অবরোধ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা ছেলে-মেয়েদের পানি দেওয়া, বিনা পয়সায় নিজের দোকান থেকে হালকা খাবার সরবরাহ আর রান্না করা ভাত-তরকারি দেওয়াসহ সাধারণ জনতা যে যেভাবে পেরেছেন শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন। তাদের আরও একটা বড় অপরাধ হচ্ছে, মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে সহায়তা চাওয়া শিক্ষার্থীদের রক্ষার চেষ্টা। বিক্ষোভকারীদের দমনে ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার ববি ক্যাম্পাস ঘেরাও করে র্যাব-পুলিশ-বিজিবি। ক্যাম্পাসের ভেতরে তখন কয়েক হাজার ছেলে-মেয়ে। ক্যাম্পাস ঘেরাওয়ের ঘটনায় মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে গ্রামবাসীর সহায়তা চায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাদের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে পাশে দাঁড়ায় এলাকাবাসী। সংঘর্ষে না জড়ালেও খাবার-পানি দিয়ে সহায়তা করে তাদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বাসিন্দা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাসিন্দা আব্দুল হালিম শিক্ষার্থীদের কলা-রুটি খাইয়েছিলেন। এ অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করে চালান দেওয়া হয়েছে নাশকতার মামলায়। প্রতিবন্ধী হোটেল শ্রমিক জামাল খাইয়েছিলেন পানি, তাকেও গ্রেপ্তার করেছে বন্দর থানা পুলিশ। এ ছাড়া রান্না করে খাবার খাওয়ানোর অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৬-৭ জনকে। এভাবে শুক্রবার রাত পর্যন্ত পুরো ইউনিয়নের বাড়ি বাড়ি হানা-তল্লাশি ও গ্রেপ্তার অভিযান চালিয়েছে পুলিশ।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কারী, ববির শিক্ষার্থী সুজয় শুভ বলেন, আন্দোলন চলাকালে খাবার দেওয়াসহ নানাভাবে স্থানীয়রা আমাদের সহায়তা করেছেন। ওইসব সাধারণ মানুষকে এখন হয়রানি করছে পুলিশ। শনিবার দুপুরে এই নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। নিরপরাধ মানুষকে আমরা হয়রানি বন্ধের দাবি জানিয়েছি। সংবাদ সম্মেলন করেও একই দাবি জানানো হয়েছে। আশা করি, এরপর আর নিরপরাধ মানুষকে পুলিশ হয়রানি করবে না।
বন্দর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ আর মুকুল পিপিএম বলেন, নিরপরাধ কাউকে আমরা গ্রেপ্তার করছি না। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ আর ভিডিও বিশ্লেষণ করে তাদেরই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে যারা নাশকতায় জড়িত ছিল। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষার্থীও গ্রেপ্তার হয়নি।