এখনও থামেনি আহাজারি
লক্ষ্মীপুরে নিরাপত্তাহীনতায় আফনান-সাব্বিরের পরিবার
লক্ষ্মীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে নিহত হওয়া আফনান পাটওয়ারি ও সাব্বির আহমেদের পরিবার এখনও নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে থানায় মামলা করে অভিযুক্ত সন্ত্রাসীদের হুমকিতে পড়ে এখন প্রাণ ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা। বাসায় তালা ঝুলিয়ে অন্যের বাসাতে আশ্রিত থাকতে হচ্ছে তাদের। তবে এসব পরিবার সন্ত্রাসীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান। এদিকে নিহত আফনান ও সাব্বিরের সহপাঠীরা তাদের কোনভাবেই ভুলতে পারছেন না। তারাও বিচার দাবি করেন।
সোমবার (১৯ আগস্ট) সরেজমিনে আফনানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শহরের বাস টার্মিনাল এলাকার আরমান মিঝি মসজিদ-সংলগ্ন আফনানের বাড়িটি অবস্থিত। তাদের বসতঘরে ঝুলছে তালা। আশপাশের লোকজন বলছেন, তারা বাড়িতে নেই, ভয়ে বাড়ি ছাড়া আফনানের মা ও একমাত্র বোন। পরে বিশেষ ব্যবস্থায় (আন্দোলনরত অন্যদের সহযোগিতায়) প্রায় ১ ঘণ্টা পর আশ্রিত গোপন ঠিকানা থেকে বাড়িতে আসেন তারা। এ সময় সহপাঠীদের দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার মা ও বোন।
আফনানের মা নাছিমা আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ৩ মাস আগে আমার স্বামী সালেহ আহমদ বিদেশে মারা গেছেন। সেই শোক সইতে না সইতে আমার ছেলেকে হারালাম। সন্ত্রাসীরা আমার মেধাবী ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমরা মামলা করেছি, এখন বিভিন্ন ফোন থেকে আমাদের আত্মীয় স্বজনদের হুমকি দিচ্ছে মামলা তুলে নিতে। এমন পরিস্থিতিতে কার কাছে যাবো আমরা। সরকারের কাছে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার দাবি করে তাদের আর দেখার কেউ নেই বলে অচেতন হয়ে পড়েন মা নাছিমা।
তার পাশে থাকা আফনানের বোন জান্নাতুল মাওয়া তাকে আগলে ধরে বলেন, আদরের ভাইটিকে সবচাইতে বেশি ভালবাসতেন মা। ৩ মাসের ব্যবধানে বাবা ও ভাই হারিয়ে এখন শোকে বিহ্বল। স্মৃতি রয়ে গেছে একটি সাইকেল।
তবে সরকারের কাছে ভাই হত্যার কঠোর বিচার দাবি করেন আফনানেন বোন।
একই দাবি জানান সহপাঠীরাও। সেদিনের ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে সহপাঠীরা জানান, বন্ধুদের সঙ্গে প্রাইভেট পড়তে গিয়ে বই খাতার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যান আফনান। হঠাৎ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের হামলায় পড়েন তারা। সহপাঠী এক শিক্ষার্থীকে (ছাত্রী) বাঁচাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন আফনান। এ সময় মাদাম ব্রিজের ওপর লুটিয়ে পড়েন তিনি। পরে তার মরদেহ উদ্ধার করে সেখান থেকে হাসপাতাল ও বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।
নিহত আফনান লক্ষ্মীপুর ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে (চলমান) এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন।
এদিকে আন্দোলনে নিহত আরেকজন সাব্বির হোসেন রাসেল। শহরের মনির উদ্দিন পাটোয়ারী বাড়ি নানার বাড়িতে থেকে পড়ালেখা চালিয়ে আসছিলেন তিনি। এইচএসসি পাস করে দালাল বাজার ডিগ্রি কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হন। ৪ আগস্ট আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন সাব্বির। তার নানার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, এখনও থামেনি পরিবারের আহাজারি। চলছে শোকের মাতম। ১৪ মাসের শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে তার স্ত্রী তর্না আক্তার, বয়োবৃদ্ধ মা-বাবাসহ পরিবার অনেকটাই রয়েছেন বাকরুদ্ধ অবস্থায়।
স্ত্রী তর্না বলেন, আমার স্বামী পৃথিবীতে নেই ভাবতেই কষ্ট লাগে, তার শরীরে ৩২টি গুলি করা হয়েছে। যারা গুলি করেছে তাদের বিচার চাই। শিশুটি নিয়ে বাঁচতে কিছু করে জীবিকা নির্বাহে সরকারি সহায়তা চান তর্না।
এ দিকে দুই মেয়ে আর এক ছেলের বড় ছেলেটাই এখন আর নেই, সে আর ফিরবেনা। তার বই খাতা নিয়ে ছেলেকে স্বরণ করছেন মা মায়া বেগম।
তিনি বলেন, ছেলে আর মা ডাকবেনা, কীভাবে ভুলি তারে, সে আমার কাঁধে হাত রেখে হাটতো, খবর নিতো এখন কে খবর নেবে, সরকারের কাছে দাবি জানাই ছেলের হত্যাকারী তাহেরপুত্র টিপু ও শাহীনসহ হত্যাকারীদের বিচার চাই। শহরের দক্ষিণ তেমুহনীকে শহীদ সাব্বির চত্বর ঘোষণা করার দাবি জানাই।
একই দাবি জানান তার বাবা আমীর হোসেন, মা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অংশগ্রহণকারী আরমান, বায়েজীদসহ অন্যান্যরা। নিহতদের বাড়িতে গিয়ে সমবেদনা জানান তারা। এ সময় জেলার ৪ শিক্ষার্থী হত্যার বিচার দাবি করেন তারা। পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিও করেন এসব শিক্ষার্থী।
মন্তব্য করুন