নওগাঁয় ৬৭টি গণকবর চিহ্নিত
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সারাদেশে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ লোকজনকে নির্বিচারে হত্যা করে গণকবর দেয়। নির্মম সেইসব গণহত্যার সাক্ষী পুরো দেশ।
১৯৭১ সালে নওগাঁ জেলার বিভিন্ন স্থানে গণহত্যার ইতিহাস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করছে স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁ। সংগঠনটির কর্মীরা এ পর্যন্ত নথিবদ্ধ করেছেন জেলার ৬৭টি গণহত্যার বিবরণ।
একুশে পরিষদের কর্মীদের নিজস্ব অনুসন্ধানে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত আর ভাষ্য নিয়ে 'গণহত্যা ১৯৭১ : নওগাঁ' শিরোনামে একটি গ্রন্থের সম্পাদনার কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। আগামী ১৯ এপ্রিল ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে এই বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হবে বলে জানান একুশে পরিষদের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আব্দুর রউফ পাভেল।
আব্দুর রউফ পাভেল বলেন, একাত্তরে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। নয় মাসের যুদ্ধে পুরো বাংলাদেশ ছিল যেন বধ্যভূমি। পাকিস্তানি সেনা আর তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামসরা নিরস্ত্র বাঙালিকে যেখানে-যেভাবে পেরেছে হত্যা করেছে। কোথাও কি লেখা হয়েছে সেই শহিদদের নাম? তাদের আত্মত্যাগের বিবরণ সংগ্রহ করার কাজটা নিঃসন্দেহে বেশ কষ্টসাধ্য। ২০১০ সালে প্রায় অসম্ভব সেই কাজটিতেই হাত দেয় একুশে পরিষদ নওগাঁর কর্মীরা। দীর্ঘ নয় বছর কাজ চলে তথ্য সংগ্রহের। নয় বছরের তথ্য সংগ্রহ শেষে একুশে পরিষদ কাজটি সম্পন্ন করে।
সংগঠনের সভাপতি ডিএম আবদুল বারী বলেন, নওগাঁয় এখন পর্যন্ত ৬৭টি বধ্যভূমি বা গণহত্যার স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। শুধু বধ্যভূমি চিহ্নিত করেই কাজ শেষ করছে না একুশে পরিষদ। গণহত্যার তারিখে ওই স্থানে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে নানা কর্মসূচি পালন করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরছে।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও 'গণহত্যা ১৯৭১ : নওগাঁ'র সম্পাদক মেহমুদ মোস্তফা রাসেল বলেন, বিভিন্ন রকম চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই আমাদের কাজটি করতে হয়েছে। প্রথমত ১৯৭১-এর ঘটনার সাক্ষী ছিলেন যারা তাদের অনেকেই আর বেঁচে নেই। যারা বেঁচে আছেন সময়ের প্রবাহে ও বয়সের ভারে অনেক কিছুই ভুলে গেছেন। দ্বিতীয়ত অনেকেই ইচ্ছা করে বা অজ্ঞতায় ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছেন। যেমন নওগাঁর পত্নীতলার হালিমনগর গণহত্যার কথাই যদি ধরি-২০০১ সালের দিকে পত্নীতলার স্থানীয় সংবাদিকদের লেখালেখির সূত্র ধরে আমরা অনুসন্ধান শুরু করি। এ সময় কিছু লোক আমাদের জানায়, এ রকম কোনও ঘটনাই ঘটেনি। আমরা ফিরে আসি। অবশেষে ২০১১ সালে আমরা খুঁজে পাই সেই গণহত্যার ঘটনায় আহত গুলু মুর্মুকে। তার সূত্র ধরে দেখা মেলে ওখানে যাদেরকে দিয়ে লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল সেই আমিনুল ও সাইফুলকে। তাদের বর্ণনায় উঠে আসে পত্নীতলার নির্মইল ইউনিয়নের হালিমনগর গ্রামে ৩০ নভেম্বর যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল তাতে ২০ জন আদিবাসীসহ অন্তত ৫০ জন শহিদ হন। ২০ জন আদিবাসীর পরিচয় উদ্ধার করা গেলেও বাকিদের পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। কারণ তারা ছিল ভিন্ন স্থান থেকে ধান কাটতে আসা মানুষ এবং সাঁওতালপল্লীতে লুকিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধা। এমনি করে একুশে পরিষদ নওগাঁর কর্মীরা নথিবদ্ধ করেছেন জেলার ৬৭টি গণহত্যার বিবরণ। এসব তথ্য-উপাত্ত আর ভাষ্য নিয়ে 'গণহত্যা ১৯৭১: নওগাঁ' শিরোনামে একটি গ্রন্থ একুশে পরিষদ প্রকাশ করতে যাচ্ছে আগামী ১৯ এপ্রিল। জাতীয় প্রেসক্লাবে এই বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হবে।
একুশে পরিষদের সংগঠনিক সম্পাদক বিষ্ণু কুমার দেবনাথ বলেন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ নওগাঁ যাত্রা শুরু করে ১৯৯৪ সালে। নওগাঁর কিছু প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, সরকারি কর্মকর্তা, ছাত্রনেতা, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ বেশ কিছু মানুষ মিলে একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে গঠিত হয় একটি সংগঠন। তখন সেই সংগঠনের নাম দেওয়া হয় ‘একুশে উদযাপন পরিষদ’। পরে মূলত কাজের ব্যাপ্তির দিকে লক্ষ্য রেখে সবার মতামতের ভিত্তিতে ২০১৫ সালে নামকরণ করা হয় 'একুশে পরিষদ নওগাঁ।'
একুশে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মনোয়ার হোসেন লিটন বলেন, এই গ্রন্থে উঠে এসেছে নওগাঁ সদরের ধামকুড়ি, পার-নওগাঁ মধ্যপাড়া, পার-নওগাঁ, মোহনপুর, দোগাছি, পার-বোয়ালিয়া, খাগরকুড়ি, নওগাঁ স্টেডিয়ামপাড়া, শেখপুরা, ফতেপুর গড়েরহাট, খাস-নওগাঁ, বলিহার চকদেব পাড়া, আরজি-নওগাঁ, হাট-নওগাঁ, মহাদেবপুর উপজেলার দেবীপুর, মহিষবাথান, মহাদেবপুর, নদীর পূর্বপাড়, আখেরা ও সিদ্দিকপুর, বাজিতপুর ও চকদৌলত; বদলগাছি উপজেলার কোলাহাট, ঐতিহাসিক পাহাড়পুর, ডাঙ্গিসার, গয়েশপুর, সেনপাড়া, লাবণ্য প্রভা; মান্দা উপজেলার পাকুড়িয়া, কবুলপুর, দেলুয়াবাড়ি-কিত্তলী, মনোহরপুর; পত্নীতলার হালিমনগর, মধইল গণহত্যা, আমন্ত, গগনপুর, দুর্গাপুর (জঙ্গলপাড়া), নজিপুরচর, মোবারকপুর, আত্রাই উপজেলার তারাটিয়া, মহাদীঘি, জালুপোঁতা-কচুয়া, পাইকড়া, সিংসাড়া, মিরাপুর, বেড়াহাসন, শিমুলিয়া, বান্দাইখাড়া, বাউল্লাহ, তারানগর, গোয়ালবাড়ি, বৈঠাখালী, রাণীনগর উপজেলার বড়বড়িয়া, আতাইকুলা, হরিপুর (রানী ভবানী জঙ্গল), ধামইরহাট উপজেলার কুলফতপুর, পাগল দেওয়ান, ফার্সিপাড়া, নিয়ামতপুর উপজেলার ভাবিচা, কারালিপাড়া (সোনারপাড়া), সাপাহার উপজেলার সাপাহার, কুচিন্দা, আশড়ন্দ, কল্যাণপুর, আইহাই, রসুলপুর সীমান্ত, পাহাড়িপুকুর, পোরশা উপজেলার শিশার গণহত্যার ঘটনাবলি।
একুশে পরিষদের এই প্রয়াস সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নওগাঁ জেলা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার হারুল-অল-রশিদ বলেন, একুশে পরিষদ যে কাজ করছে নিঃসন্দেহে এটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু গণকবরগুলো শুধু চিহ্নিত করলেই হবে না। সংরক্ষণও করতে হবে। এগুলো সংরক্ষণ করা প্রশাসনের দায়িত্ব।
জেবি
মন্তব্য করুন