স্থবির হয়ে আছে সৃষ্টিশীল নির্মাতাদের সংগঠন ডিরেক্টরস গিল্ড
নাট্য নির্মাতাদের সংগঠন ডিরেক্টরস গিল্ড বাংলাদেশ। ২০২৩ সালের ১০ মার্চ সংগঠনটির ২০২৩-২৫ মেয়াদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে নতুন সভাপতি অনন্ত হিরা ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এস এম কামরুজ্জামান সাগর। এই নির্বাচনে একই সঙ্গে প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন পদে নির্বাচিত হন আরও ১৯ জন সদস্য।
তবে সেই নির্বাচনের ছয় মাস পার না হতেই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ওপর অনাস্থা আনে একই বছরের ১৫ অক্টোবর কার্যনির্বাহী পরিষদের ১৭ জন সদস্য। ১৯টি কারণ দেখিয়ে এক চিঠিতে অনাস্থা জানানো হয়।
মঙ্গলবার (০৫ মার্চ) সন্ধ্যায় ডিরক্টরস গিল্ড বাংলাদেশ চলমান সংকট তুলে ধরতে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলন করেন অনাস্থাকারী ১৬ জন নির্বাচিত সদস্য। এসময় সমন্বয়কারী শহিদুজ্জামান সেলিম ও এস এ হক অলিকসহ আরও উপস্থিত ছিলেন— প্রযোজক আরশাদ আদনান, প্রযোজক, নির্মাতা, অভিনেতা সাজ্জাদ হোসেন দোদুল, নির্মাতা ফরিদুল হাসান প্রমুখ।
সেখানে বিভিন্ন পদে নির্বাচিত ১৭ জন সদস্যের নাম ও স্বাক্ষর রয়েছে। ডিরেক্টর গিল্ডের সভাপতি অনন্ত হীরা বরাবর এই চিঠি পাঠানো হয় ১০ অক্টোবর। সেটি সভাপতি বা তার প্রতিনিধি গ্রহণ করেন ১৫ অক্টোবর।
অনাস্থা জানানোর কারণগুলো উল্লেখ্য করতে গিয়ে সেই চিঠিতে লেখেন, ডিরেক্টরস গিল্ড বাংলাদেশের ২০২৩-২০২৫ মেয়াদের নির্বাচিত কার্যনির্বাহী পরিষদের নিম্ন স্বাক্ষরকারী সদস্যরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে, শপথ গ্রহণের পর থেকে আপনি (সভাপতি), সাধারণ সম্পাদক নানা রকম অগঠনতান্ত্রিক, অসাংগঠনিক, স্বেচ্ছাচারী, বিভ্রান্তিকর, আস্থাহীনতা, সমন্বয়নহীনতা, দায়িত্ববোধের নির্বুদ্ধিতা নির্বাচিত অন্য কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যদের কাজ করতে না দেওয়া, নির্বাচিত সদস্যদের হেয় করাসহ নানাবিধ অনিয়মে সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। তাই সংগঠন ও গঠনতন্ত্রের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে এবং সংগঠনকে গঠনতন্ত্র মোতাবেক পরিচালনা করতে, সংগঠনকে এগিয়ে নিতে এবং আপনাদের অগঠনতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের হাত থেকে সংগঠনকে বাঁচাতে আপনার (সভাপতি) ও সাধারণ সম্পাদকের ওপর অনাস্থা প্রকাশ করছি।
আট পাতার এই চিঠিতে বিভিন্ন সময়ে ঘটা ঘটনার কথা উল্লেখ করে অনাস্থার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। স্বাক্ষরিত ১৭ জনের তালিকায় আছেন সংগঠটির সহ-সভাপতি কায়সার আহমেদ, মনোজ সেনগুপ্ত ও আশরাফুল আলম রন্টু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাশেদা আক্তার লাজুক ও ফিরোজ খান, অর্থ সম্পাদক আবু রায়হান জুয়েল, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জহির খান, প্রশিক্ষণ ও আর্কাইভবিষয়ক সম্পাদক শুভ্র খান, আইন ও কল্যাণবিষয়ক সম্পাদক তারিক মুহাম্মদ হাসান, দপ্তর সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন সাইদুর রহমান এবং কার্যনির্বাহী সদস্য এস এম শহিদুল ইসলাম রুনু, গাজী আপেল মাহমুদ, দীন মোহাম্মদ মন্টু, নাসির উদ্দিন মাসুদ, ফিরোজ আহমেদ দুলাল, শাহীন মাহমুদ ও সৈয়দ আওলাদ।
অনাস্থা দিয়ে আস্থা ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন কমিটির ১৭ জন। কিন্তু মতের অমিলে সেই আস্থা ফিরে আসেনি। ২১ জন নিয়ে গঠিত কমিটি এখন দুই ভাগে বিভক্ত! স্থবির হয়ে আছে প্রায় আটশো জন সৃষ্টিশীল নির্মাতাদের প্রাণের সংগঠন ডিরেক্টরস গিল্ড। অনাস্থা আনা ১৭ জনের বিরুদ্ধে উকিল নোটিশ দেন এবং সেইসঙ্গে তাদের ৮ জনের সদস্যপদ স্থগিত করেন সভাপতি অনন্ত হীরা ও সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান সাগর। এখানেই শেষ নয়, অনাস্থা আনা ১৭ জনের পদ কো-অপ্ট করে নতুন করে ১৭ জন নিয়ে হীরা ও সাগর কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। যা আইন বহির্ভূত বলে মনে করছেন অনাস্থাকারীরা।
চলমান সংকট সমাধানে গত বছরের ২৪ নভেম্বর মুক্ত আলোচনা সভা করা হয়। সেখানে সাধারণ সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে সংকট নিরসনে গাজী রাকায়েত, সালাউদ্দিন লাভলু, শহিদুজ্জামান সেলিম, রোকেয়া প্রাচী, এস এ হক অলিক, সৈয়দ শাকিল ও ইমরাউল রাফাতকে সমন্বয়কারী সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিলেও ফলপ্রসূ হয়নি। সমন্বয়কারীদের দাবি, তাদের উপেক্ষা করেই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তাদের কার্যক্রম চলমান রেখেছেন।
সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য শহিদুজ্জামান সেলিম বলেন, ১৬ জন নির্বাচিত সদস্য আমাদের আমন্ত্রণ করেছিল সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য। নিয়ম অনুযায়ী যে কোনো সদস্য এমন সভা ডাকতে পারেন। এসময় প্রায় তিনশো সদস্যদের উপস্থিতিতে সেই সভায় কয়েকজনকে নিয়ে সমন্বয়কারী করা হয়। যারা উভয় পক্ষকে নিয়ে বসে চলমান সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখবেন। আমাদের সিনিয়র উপদেষ্টা মুস্তফা মনোয়ার, নাসির উদ্দিন ইউসুফ, ম হামিদ এর সঙ্গে আলাপ করলে তারা আমাদের সমাধানের জন্য বলেন। দুই পক্ষের মধ্যে সমাধানের চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু অতীব দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, চার জন মিলে সংগঠনের অফিস দখল করে রেখেছেন। অফিসে চলমান সমস্যা নিয়ে মিটিং করতে পারিনি৷ সদস্যদের চাঁদায় অফিস ভাড়া হয় কিন্তু এই চারজন তাদের ব্যক্তি স্বার্থে তা ব্যবহার করছে। নিজেদের প্রয়োজন ছাড়া তালাবদ্ধ রাখেন। বহুবার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি।
তিনি আরও বলেন, সংগঠনের ব্যানারে তারা আগামী ৯ মার্চ একটি পিকনিকের আয়োজন করেছেন। যেখানে সমস্যা সমাধানের খবর নেই সেখানে এই চারজন অন্যায় ভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। সংবাদ সম্মেলনে এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
নাট্য নির্মাতাদের সবচেয়ে পুরনো সংগঠনটির সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন প্রযোজক আরশাদ আদনান। তিনি বলেন, এই সংগঠনের সঙ্গে অনেক আগেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছি। গিল্ডের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিজেদের মতো করে সংগঠনটি চালাচ্ছে। তারা কারো কথার তোয়াক্কা করছে না৷ যে কয়জনকে কো-অপ্ট করা হয়েছে তা নিয়মনীতি ছাড়াই। এই ঐতিহ্যবাহী সংগঠনে এমনটা চলতে দেওয়া যায় না। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বিষয়টি নিয়ে ডেকেছিলাম তারাও বিষয়টি সমাধান করতে চায়। কিন্তু আমাকে জানায় পিকনিকের আয়োজন করে ফেলেছে। পিকনিকের পরে বিষয়টি নিয়ে বসতে চায়। পিকনিকের আগে তাদের বসার আহ্বান জানাই। আমি চাই চলমান সংকট সুস্থ সমাধান হোক অতি দ্রুত। পিকনিকের আগে তাদের পছন্দ মতো লোকজন নিয়ে যাতে সমস্যার সমাধান করে। সমাধান করে সবাই মিলে পিকনিক করার আহ্বান করছি৷ আগে সমাধান জরুরি।
এসময় আরশাদ আদনান বলেন, নির্বাচিত সদস্যদেন বাদ দিয়ে সিলেক্টেডদের নিয়ে কিভাবে পিকনিক করে? এটা কি সম্ভব? সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান সাগর অনেক মিথ্যা কথা বলে। কথায় কথায় মিথ্যা বলে। ডিরেক্টরস গিল্ডের চলমান সংকট নিরসন এসময় সংবাদমাধ্যমের সহযোগিতা কামনা করেন এই প্রযোজক।
এক বার্তায় জানানো হয়, নির্বাচনের পর থেকে অনিয়ম, অগঠনতান্ত্রিক ও অসাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের কারণে বর্তমান সভাপতি অনন্ত হিরা, সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান সাগর, সাংগঠনিক সম্পাদক (বিনা ভোটে) শামীম রেজা জুয়েল, তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক সবুজ খান, কার্যনির্বাহী পরিষদ সদস্য সৈয়দ আওলাদ সহ তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধেও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব। এমনটা চলতে থাকলে ডিরেক্টরস গিল্ড নামের সংগঠনটি বিলীন হয়ে যাবে, যা কোনো ভাবেই কাম্য নয়। এই বিশৃঙ্খলা ও নাজুক পরিস্থিতি থেকে মুক্ত করার প্রত্যয়ে দ্রুত সমাধান প্রত্যাশা করছি।
মন্তব্য করুন