ঢাকাMonday, 17 March 2025, 3 Choitro 1431

ব্যক্তিজীবনের ঝড়ো হাওয়ার প্রভাব যখন সিনেমায়

মাহফুজুর রহমান

শনিবার, ১৭ জুন ২০২৩ , ০৪:০৬ পিএম


loading/img

প্রেম, বিয়ে, বিচ্ছেদ-এর কোনোটাই তারকাদের ব্যক্তিগত নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সিনেমার স্বার্থ, থাকে শত মানুষের ক্যারিয়ারের ঝুঁকি। প্রযোজকের কোটি টাকা একরকম জুয়াখেলায় পরিণত হয়, যখন তার নির্মাণাধীন ছবির নায়ক-নায়িকা বিয়ে করে ফেলে কিংবা বিচ্ছেদ ঘটায়।

বিজ্ঞাপন

একসময় তো নির্মাতারা শিল্পীদেরকে শর্ত দিয়ে নিতেন যে, ছবি মুক্তির আগে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে পারবেন না তারা। তাদের প্রেমের গসিপ পত্রিকায় বেরুলে নির্মাতারা আতঙ্কিত হয়ে উঠতেন ছবির ব্যর্থতার কথা ভেবে।

সেই জায়গা থেকে পরিচালক-প্রযোজকরা সরে এসেছেন। দর্শকরা পরিণত হয়ে উঠেছেন, পর্দার সঙ্গে বাস্তবের তফাৎ বুঝতে শিখেছেন, এমনটাই ভাবেন এই প্রজন্মের নির্মাতারা। এতে অবস্থার বৈপ্লবিক কোনো পরিবর্তন হয়নি।

বিজ্ঞাপন

তারকারা এখনও একসঙ্গে ছবি করতে গিয়ে প্রেমে পড়েন, একসঙ্গে ছবি না করলেও হৃদয় উজার করে দেন সহকর্মীকে। এর জন্য নির্মাতাকে আজও ভুগতে হয়, দূর অতীতের মতোই।

শাকিব খান ও অপু বিশ্বাস তাদের প্রেম ও বিয়ের কথা জনসম্মুখে প্রকাশ করেননি গ্রহণযোগ্যতা হারানোর ভয়ে। একটা সময়ে গিয়ে আর লুকোছাপা করা সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। একপর্যায়ে বিয়েবিচ্ছেদের মতো তিক্ত সিদ্ধান্তও নিতে বাধ্য হোন তারা। এটা তাদের একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত হলেও ক্ষতির শিকার হলেন কে? ক্ষতিগ্রস্ত হলেন কিন্তু তাদের ছবির নির্মাতারা।

প্রথম কোপটা পড়ল বুলবুল বিশ্বাসের কাঁধে। বিচ্ছেদের পর  কিং খান ও ঢালিউড কুইনের প্রথম ছবি আসে 'রাজনীতি', এই ছবির সঙ্গেই আসে 'নবাব'। ‘নবাব’ এর জন্য ব্যাপক প্রচারণা করলেও শাকিব খান সম্পূর্ণ বিরত থাকেন 'রাজনীতি' ছবিটির প্রচারে।

বিজ্ঞাপন

অপু বিশ্বাস একা-একা তার ছবির পাবলিসিটি করেন। না তার ছবির প্রযোজনা সংস্থা কোনো মাফিয়াচালিত, না তার পরিচালক কোনো প্রতিষ্ঠিত নির্মাতা। একজন নবাগত চিত্রপরিচালককে পাশে নিয়ে অপু একাই দৌড়েছেন হল থেকে হলে। সেদিন তিনি কাউকে পাশে পাননি; না মিডিয়াকে, না তার সহশিল্পীকে।

চূড়ান্তভাবে ক্ষতিটা অপুর চেয়েও কয়েক গুণ বেশি হয়েছে 'রাজনীতি'র প্রযোজক ও পরিচালকের। নির্মাণে কোনো রকম ত্রুটি না রাখার পরও তাদের ছবিকে ত্যাজ্য করেন শাকিব খান। শুধু অপুর সঙ্গে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব থাকায় তিনি ছবিটির পাশে দাঁড়াননি। 

একইভাবে এরপর মুক্তি পায় 'পাঙ্কু জামাই'। এই ছবিটিও সিনেমা হলে ভালো চলেনি। ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটির পক্ষে কোথাও কিছু বলেননি শাকিব খান। নিজের সন্তানতুল্য ছবিকে অস্বীকার করতে তিনি দ্বিধা করেননি। স্রেফ প্রাক্তন স্ত্রীর সঙ্গে বিরোধ থাকায় ছবির প্রযোজক-পরিচালককে ক্ষতিগ্রস্ত করতে তার বিবেচনায় একটুও বাধেনি। দেশটা সব সম্ভবের বাংলাদেশ বলেই তিনি পারলেন এমন অবিবেচকের মতো কাজ করতে। অন্য কোনো দেশ হলে নির্মাতারা আদালত চত্বরে তাকে নরক দেখিয়ে ছাড়তেন।

ঘটনার এখানেই শেষ নয়। মনতাজুর রহমান আকবর ও কালাম কায়সার ছবি নির্মাণ করছিলেন শাকিব ও অপুকে নিয়ে। নির্মাণের মাঝপর্যায়ে তাদের জুটি ভেঙে যায়, বিচ্ছেদ ঘটে। যদি এই নির্মাতাদ্বয় ঘুণাক্ষরেও জানতেন তারা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে বিচ্ছেদ ঘটাবেন, তবে নিশ্চয়ই তারা এই দুই তারকার ওপর টাকা ঢালতেন না?

আর এই অপেশাদার দুজন শিল্পীর ওপর বিনিয়োগ করাই কাল হয় তাদের জন্য। আটকে যায় ‘মা’ ও ‘লাভ ২০১৫’ ছবির কাজ। ২০২৩ চলে এলেও ‘লাভ ২০১৫’ কিংবা ‘মা’ ছবির কাজ শেষ করা যায়নি দুই তারকার পরষ্পর বিরোধিতার কারণে। চলচ্চিত্রের সমিতিগুলোতে অভিযোগ করেও দুই ছবির নির্মাতা শিডিউল মেলাতে পারেননি শকিব ও অপুর।

আর ছবি শেষ করলেইবা কী হত? না তারা প্রচারণায় অংশ নিতেন, না দর্শকরা ভেঙে যাওয়া জুটির ছবির প্রতি আগ্রহ দেখাতেন। যখন দর্শকরা জেনে গেছেন এই রোমান্টিক জুটি একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন, গণমাধ্যমে একে অন্যের ওপরে বিষ উগড়ে দিচ্ছেন, তখন পর্দায় তাদের রোমান্টিক অভিনয় কতটা বিশ্বাসযোগ্য হত?

শাকিব-অপু্র মতো জনপ্রিয় জুটি যাদের সুপারহিট ছবির সংখ্যা এক ডজনেরও বেশি, অনেক বছর ধরে বিনিয়োগ করে যাদের জুটিকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, হঠাৎ ঝড়ে তাদের জুটি ভেঙে যাওয়া ছিল সিনেমার এক মস্ত ক্ষতি। এই লোকসানটা হল তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ায়।

হুবহু একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে দেখা গেল শাকিব-বুবলী জুটির বেলায়। শাকিব-অপু জুটি ভেঙে যাওয়ার পর শাকিবের আগ্রহে তৈরি হল শাকিব-বুবলী জুটি। নির্মাতারা চান বা না-চান, শাকিব খানের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে প্রতিষ্ঠা পেল শাকিব-বুবলী জুটি।

একসঙ্গে ১২টি ছবি করার পর শাকিব-বুবলী জুটিও এখন অস্তাচলের দিকে। কারণ, দুজনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক আর আগের জায়গায় নেই। এতে আরো একটি জুটির ওপরে প্রডিউসারদের ইনভেস্টমেন্ট ভেসে গেল। 

যারা বলেন ব্যক্তিজীবন তারকার ক্যারিয়ারে প্রভাব ফেলে না, তারা তারকার ক্যারিয়ারের মতো ক্ষুদ্র ঘটনার মধ্যে পাঁক খাচ্ছেন- সিনেমার বৃহৎ স্বার্থ তাদের চোখে ধরা পড়ছে না।

একটি জুটি ভেঙে যাওয়ার বা জুটির ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তার কুফল দেখা দেয় পর্দায়। দর্শকরা বিবদমান জুটির ছবি থেকে মুখিয়ে ফিরিয়ে নেন পুরোপুরি। আর সিনেমার চালক নির্মাতা আর চালিকাশক্তি প্রযোজকদের ক্ষতি কিভাবে হয়, তার বিস্তারিত তো ওপরেই বর্ণনা করলাম।

এসব দুর্ঘটনা থেকে সিনেমাওয়ালাদের শিক্ষা নেয়ার সময় বোধহয় এসেছে। যারা ব্যক্তিজীবন আর পর্দাজীবনের মধ্যে রচিত লাইন অব কন্ট্রোলটুকু দেখতে পান না কিংবা দেখেও অসতর্ক থাকেন, তাদের ব্যাপারে সাবধান হওয়ার প্রয়োজন, এখনই।

লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, আরটিভি

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন

Loading...


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |