ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলাকে ঘিরে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি হয়েছে। এরই মধ্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে দুদেশ। পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আর হুমকি-ধামকিতে ক্রমেই বাড়ছে সংঘাতের শঙ্কা; যা গড়াতে পারে ‘যুদ্ধ’ পর্যন্ত।
পাকিস্তানকে শায়েস্তা করতে ইতোমধ্যেই নতুন এক কৌশল প্রয়োগ করেছে ভারত। পূর্বঘোষণা ছাড়াই সিন্ধুর উপনদী ঝিলামের পানি ছেড়ে দিয়েছে ভারত। এতে করে মাঝারি ধরনের বন্যার কবলে পড়েছে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরের একাংশ। আকস্মিক এ বন্যার ব্যাপারে জরুরি অবস্থাও ঘোষণা করা হয়েছে আজাদ কাশ্মিরের রাজধানী মুজাফফরাবাদে।
রোববার (২৭ এপ্রিল) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল।
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, পাকিস্তানকে কোনো ধরনের পূর্বসংকেত না দিয়েই মুজাফফরাবাদের হাত্তিয়ান বালা এলাকায় ঝিলম নদীতে অতিরিক্ত পানি ছেড়েছে ভারত। এই হঠাৎ পানিপ্রবাহের কারণে জরুরি ভিত্তিতে ‘পানি জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করেছে মুজাফফরাবাদ প্রশাসন।
বিবৃতিতে মুজাফফরবাদ প্রশাসনের মুখপাত্র বলেছেন, ঝিলাম নদীতে ভারত স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পানি ছাড়ায় মাঝারি বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে সেখানকার বাসিন্দাদের সতর্ক থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম দুনিয়া নিউজ জানিয়েছে, পাকিস্তানকে অবহিত না করেই শনিবার নদীর পানি বেশি পরিমাণে ছাড়তে শুরু করে ভারত। এরপর হু হু করে পানি বেড়ে যায় ঝিলাম নদীর। ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের অনন্তনাগ থেকে পাকিস্তানের চাকোঠি দিয়ে প্রবেশ করছে এই পানি। বন্যার বিষয়ে সতর্ক করতে মসজিদ থেকে স্থানীয়দের মাইকিং করতে শোনা গেছে। এতে করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে নদীতীরের মানুষের মধ্যে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো ধরনের আগাম নোটিশ ছাড়া পানি ছেড়ে দেওয়া আন্তর্জাতিক আইন এবং দুই দেশের মধ্যে নদী ব্যবস্থাপনা বিষয়ক চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ভারতের এই আচরণ পাকিস্তানের জনগণের জীবন ও সম্পদের ওপর সরাসরি হুমকি তৈরি করেছে এবং তাদের বৈরিতার আরেকটি উদাহরণও প্রকাশ করেছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানিচুক্তি অনুযায়ী, নদীতে পানি প্রবাহ সংক্রান্ত যেকোনো বড় সিদ্ধান্ত সম্পর্কে উভয় দেশকে একে অপরকে আগে থেকেই অবহিত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ভারতের এই অপ্রত্যাশিত পানি ছাড়ার ঘটনায় পাকিস্তানে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বেড়ে গেছে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে থাকা সিন্ধু নদের একটি উপনদী হলো ঝিলাম। ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার জের ধরে সৃষ্ট উত্তেজনার মুখে এরই মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে থাকা সিন্ধু নদের পানি চুক্তি স্থগিত করেছে নয়াদিল্লি; হুমকি দিয়েছে পাকিস্তানকে সিন্ধু নদের এক ফোঁটা পানিও দেওয়া হবে না। অন্যদিকে পাকিস্তান বলেছে, সিন্ধুর প্রবাহ আটকানোর চেষ্টা করা হলে এটিকে তারা যুদ্ধের ঘোষণা হিসেবে বিবেচনা করবে এবং সেই অনুযায়ীই সামরিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে তাদের পক্ষ থেকে।
প্রসঙ্গত, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে প্রতিপক্ষকে বিপাকে ফেলা বা শায়েস্তা করার কৌশল হিসেবে বাঁধ ভেঙে কিংবা পানি ছেড়ে দিয়ে বন্যায় ভাসানোর এ নজির নতুন নয়। এর আগেও বিভিন্ন যুদ্ধে এ ধরনের কৌশল অবলম্বন করতে দেখা গেছে বিভিন্ন পক্ষকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তিন বছর ধরে চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কথা।
যুদ্ধের শুরুর দিকে ২০২২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের ক্রিভি রিহ শহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হয় প্রধান একটি বাঁধ। এতে প্রতি সেকেন্ডে ১০০ কিউবিক মিটার পানি প্রবাহিত হয় ইনহুলেটস নদীতে; হু হু করে বিপজ্জনক পর্যায়ে উঠে যায় পানির স্তর। এ ঘটনার পর রাশিয়াকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।
এরকমই আরেকটি ঘটনা ঘটে ২০২৩ সালের ৬ জুন। বিস্ফোরণে উড়ে যায় ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ ও বিশাল একটি বাঁধ; আকস্মিক বন্যার ঝুঁকিতে পড়েন প্রায় ৪২ হাজার মানুষ। বিশাল এই বাঁধ ধ্বংসের জন্য একে অপরকে দোষারোপ করে ইউক্রেন এবং রাশিয়া। তবে, বাঁধটি যারাই ধ্বংস করুক, এটি ইউক্রেনের যুদ্ধ অঞ্চলের একটি বিশাল অংশজুড়ে বন্যা সৃষ্টি করে এবং হাজার হাজার মানুষকে বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে।
আরটিভি/এসএইচএম/এআর