ঢাকাসোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫, ২৩ আষাঢ় ১৪৩২

বন্ধ হোক সিজার বাণিজ্য, সুস্থ থাকুক মা ও শিশু

আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ যুবায়ের

মঙ্গলবার, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০১:৪৮ পিএম


loading/img
ফাইল ছবি

রাস্তায় দেখা হলো আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ একজনের সঙ্গে। জিজ্ঞেস করলাম, আপনার সন্তান কেমন আছে? আফসোস করে তিনি বলতে শুরু করলেন, আর বইলেন না ভাই, আমার স্ত্রীর সিজার করার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। কিন্তু ডাক্তার টাকার জন্য জোর করে সিজার করাল। এরপর সে অনেকক্ষণ ডাক্তারকে গালামন্দ করলেন। আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম, আপনি ডাক্তার নন, আপনার স্ত্রীর সিজার না নরমাল ডেলিভারির প্রয়োজন ছিল, তা আপনার বোঝার কথা না। এবার তিনি আমার ওপর আরও ক্ষিপ্ত হলেন। বললেন, স্ত্রী প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকে যেসব ডাক্তার দেখিয়েছি, সবাই নরমাল ডেলিভারির কথা বলেছেন। সন্তান প্রসবের পরেও তারা বলেছেন, সিজারের প্রয়োজন ছিল না। 

বিজ্ঞাপন

আমি বললাম, যারা নরমাল ডেলিভারির পরামর্শ দিয়েছিলেন এমন ডাক্তারের কাছে নিলেই পারতেন। তিনি বললেন, বড় ডাক্তারের কাছে মানুষ আস্থা পায় বেশি। এ জন্য তাদের কাছেই মানুষ বেশি যায়। এই সুযোগে তারা রোগীদের গলা কাটে! এ রকম অভিযোগ অসংখ্য মানুষের। কেন বাংলাদেশে সিজার বাড়ছে এবং নরমাল ডেলিভারির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন অনেক ডাক্তার সিজারে আগ্রহী। এই নিবন্ধে সেসব বিষয় মোটামুটিভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। 

২৯ আগস্ট সোমবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সংসদে বলেছেন, বর্তমানে দেশে সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে নরমাল ডেলিভারির হার ৬৯ শতাংশ এবং সিজারিয়ান ৩১ শতাংশ। 

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, নরমাল ডেলিভারিতে আগ্রহী করে তুলতে ‘প্রমোশন অব নরমাল ভ্যাজাইনাল ডেলিভারি, প্রিভেনশন অব আননেসেসারি সিজারিয়ান সেকশন অ্যান্ড ক্রিয়েটিং অ্যাওয়ারনেস অ্যাবাউট নেসিসিটি অ্যান্ড জাস্টিফিকেশন অব ক্রিয়েশন সেকশন’ শীর্ষক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এছাড়া জেলা-উপজেলায় মিডওয়াইফ লেড কেয়ার সার্ভিস শক্তিশালী করা হচ্ছে এবং নতুন করে মিডওয়াইফ নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। মিডওয়াইফদের মাধ্যমে অন্তঃসত্ত্বাদের নরমাল ডেলিভারির ইতিবাচক দিক এবং অপ্রয়োজনীয় সিজারের নেতিবাচক বিষয়গুলো অবহিত করা হচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় সিজার কমাতে চলছে বিভিন্ন মনিটরিং কার্যক্রম। 

স্বাস্থ্যমন্ত্রী সংসদে যা বলেছেন, তা মানুষের মনে আশার সঞ্চার করে। দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশের মানুষ সরকারের তরফ থেকে যা শোনে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার বাস্তবায়ন দেখতে পায় না। যেমন- আগস্ট মাসে গণপরিবহনে ওয়েবিল প্রথা বাতিল করা হলো। কয়েকদিন গাড়ি চলাচল কমে গেল। এখন আবার রাজধানীতে ওয়েবিল প্রথা মেনেই চলাচল করছে বাস। কেউ থামাতে পারছে না বাস শ্রমিকদের। সরকারের ঘোষণা এবং মন্ত্রীদের আশ্বাসের পরও যখন কোনোকিছুর বাস্তবায়ন হয় না, তখন মানুষের মনে নানা ধরনের প্রশ্ন আসে। কেউ বলেন, সরকারের তরফ থেকে বক্তব্য দিয়ে জনগণকে বুঝ দেওয়া হয়েছে। কেউ বলেন, সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অপশক্তির বাধার কারণে ভালো উদ্যোগগুলোর বাস্তবায়ন হয় না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশে উল্লেখ আছে, একটি দেশের মোট সন্তান প্রসবের ১০-১৫ শতাংশ সিজারের মাধ্যমে হতে পারে। মোট প্রসবের ন্যূনতম ৮৫ শতাংশ হওয়া উচিত সব ধরনের স্বাস্থ্য সুবিধা সংবলিত হাসপাতালে। বাংলাদেশে এর চিত্র উল্টো। 

বিজ্ঞাপন

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০২১ সালের তথ্য, ২০২০ সালে প্রকাশিত সরকারের স্বাস্থ্য বুলেটিন, বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৭-১৮ এবং সেভ দ্য চিলড্রেনের ২০১৯ সালের প্রকাশিত প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছে, তা হলো- বাংলাদেশে সিজারিয়ান ডেলিভারির হার ৪৪ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশে সিজারিয়ান ডেলিভারির যে হার উল্লেখ রয়েছে, তার চেয়ে বাংলাদেশে ২৯ শতাংশ সিজারিয়ান ডেলিভারি বেশি হচ্ছে। জরিপে উঠে এসেছে, গত পাঁচ বছরে সিজারিয়ান ডেলিভারির হার ৩৩ শতাংশ বেড়েছে এবং নরমাল ডেলিভারি ৩১ শতাংশ কমেছে। যা সত্যিই উদ্বেগের।

বিজ্ঞাপন

অন্যদিকে, বাংলাদেশে মোট ডেলিভারির ৫০ শতাংশ স্বাস্থ্য সুবিধা-সংবলিত হাসপাতালে হচ্ছে না। আত্মীয় বা অপ্রশিক্ষিত ধাত্রীর মাধ্যমে এসব ডেলিভারি বাসা-বাড়িতে কিংবা অবৈধ ক্লিনিকে হচ্ছে। অর্থাৎ এখনো আমাদের দেশের ৫০ শতাংশ গর্ভবতী নারী প্রসবকালীন সময়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

সরকারি হাসপাতালগুলোতে সেবা নিতে গিয়ে দুর্ব্যবহারের শিকার হন অধিকাংশ মানুষ। সামান্য সুবিধা পাওয়ার জন্য দিতে হয় ঘুষ। অনেক চিকিৎসকের ব্যবহার এতটাই খারাপ যে, তাদের ব্যবহারে সুস্থ  মানুষও অসুস্থ হয়ে যায়। সরকারি হাসপাতালে গিয়ে, অধিকাংশ সময় মিনতি করেও ডাক্তারের সঙ্গে অল্প সময় কথা বলা যায় না। শত চেষ্টা করেও ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা সম্ভব হয় না। এসব কারণে ভালো চিকিৎসা ও ব্যবহারের আশায় মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে যান। সুযোগের অপব্যবহার করে বেসরকারি হাসাপাতালের অধিকাংশ ডাক্তার অর্থলিপ্সার কারণে নরমাল ডেলিভারি না করে সিজার করে থাকেন। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর জরিপ অনুযায়ী ৮৪ শতাংশ সিজারিয়ান ডেলিভারি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে হয়। 

দুর্ব্যবহার এবং নানান সমস্যা সহ্য করেও যারা সন্তান প্রসবের জন্য সরকারি হাসপাতালে যান, তারাও সিজারিয়ান ডেলিভারি থেকে রক্ষা পান না। অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। যে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে রোগীকে সিজার করতে বাধ্য করা হচ্ছে। রোগী তো দূরের কথা, হাসপাতালের কর্মচারীরাও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করার ক্ষমতা রাখেন না! চুপ করে সয়ে নিতে হয় সব অন্যায়।

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম রাজনৈতিক স্থিতিশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ সিজারিয়ান ডেলিভারিতে শীর্ষে। পাকিস্তানে সিজারের হার ২৩ শতাংশ। ভারতে ২১.৫ শতাংশ। নেপালে ১৫ শতাংশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে ৬.৬ শতাংশ। 

২৮ মে দৈনিক দেশ রূপান্তরকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেছিলেন, নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে সরকার কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে। সিজারিয়ান ডেলিভারি কমানোর ক্ষেত্রে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। অবৈধ ক্লিনিক বন্ধ করা হবে এবং বৈধ হাসপাতালগুলোতে নরমাল ডেলিভারির ব্যবস্থা যেন রাখা হয়, সেজন্য সময় বেঁধে দেওয়া হবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সিজারিয়ান ডেলিভারির ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে, ফলে রোগীদের নরমাল ডেলিভারির জন্য অনুরোধ করার সুযোগই থাকে না। 

স্বাস্থ্যের অতিরিক্ত মহাপরিচালকের বক্তব্যের পর তিন মাস হয়ে গেল। কিন্তু অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। সেভ দ্য চিলড্রেনের বক্তব্য অনুযায়ী, সরকারকে সিজারিয়ান ডেলিভারির ক্ষেত্রে অনেক পরামর্শ দেওয়া হলেও এখনো পর্যন্ত তাদের কোনো পরামর্শ আমলে নেওয়া হয়নি।

সন্তান সিজারে হবে এটা এখন ফ্যাশন। নরমাল ডেলিভারিতে সন্তান হলে অনেক নারী তা বলতে লজ্জা পান। আধুনিক গর্ভবতী মায়েরা এখন কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চান না। সন্তান প্রসবের কষ্ট সহ্য করার মতো সাহস ও ধৈর্য্য নেই বর্তমান যুগের অধিকাংশ নারীদের। গর্ভবতী মায়েদের অনেকেই ডাক্তারকে বলেন, আমার সিজার করবেন, নরমাল ডেলিভারি যেন না হয়। নরমাল ডেলিভারির জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়, সে প্রস্তুতি নিতেও তারা রাজী নন। যদি বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বর্তমান যুগের গর্ভবতী মায়েদের সিজারের ক্ষতি বুঝিয়ে বলতেন, সিজারের হার কমে যেত। কিন্তু বেশি অর্থ আয় করার জন্য অনেক ডাক্তার বর্তমান যুগের গর্ভবতী মায়েদের সচেতন নারী উপাধি দিচ্ছেন। চমৎকার চমৎকার শব্দের প্রয়োগ করে নারীদের সিজারে আগ্রহী করে তুলছেন। একজন সৎ ডাক্তারের জন্য এমন কাজ করা কোনভাবেই উচিত নয়।

সিজার হলে নারীর স্বাভাবিক জন্মদানের ক্ষমতা কমে যায়। অনেক সময় সিজারের স্থানে ইনফেকশন ও রক্তপাত হয়। কখনো কখনো বাচ্চার শ্বাস-প্রশ্বাসের জটিলতা ও নিউমোনিয়া হতে পারে। মায়ের জরায়ুর ইনফেকশন, পেটের নানান সমস্যা এবং পরবর্তীতে মাসিকের সমস্যাও হতে পারে। সাধারণত প্রথম সন্তান সিজারে হলে দ্বিতীয় সন্তানের জন্যও একই পথে হাঁটতে হয়। ফলে একজন মা নিজের শরীরের স্বাভাবিক সক্ষমতা সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলেন।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সিজারিয়ান ডেলিভারের হার অনেক কমে এসেছিল। সরকারি হিসাব অনুযায়ী ২০২০ সালের জানুয়ারিতে নরমাল ডেলিভারি হয়েছে ৫০ হাজার ৮৭৮টি; যেখানে সিজার হয়েছে ৪৩ হাজার ৮৭৯টি। ফেব্রুয়ারি মাসে সিজার হয়েছে ৩৯ হাজার ৮৩২টি, মার্চে ৩৭ হাজার ৪১১টি, এপ্রিলে ৩২ হাজার ৫৯১টি এবং সর্বশেষ জুলাই মাসে ৩২ হাজার ১৭৩টি নরমাল ডেলিভারির বিপরীতে সিজার হয়েছে ২৬ হাজার ৮০২টি। 

করোনাকালের পরিসংখ্যান দেখলে সহজেই বলা যায়, আমাদের দেশের অধিকাংশ গর্ভবতী মায়েদের সিজার করার প্রয়োজনই হয় না। অপ্রয়োজনে ডাক্তাররা সিজার করে থাকেন। যাকে সিজার বাণিজ্য বলা যায়।

গাইনি বিশেষজ্ঞদের উচিত গর্ভবতী মায়েদের নরমাল ডেলিভারিতে উৎসাহিত করা। তাদেরকে সাহস দেওয়া। যেভাবে চললে নরমাল ডেলিভারি করা সম্ভব হবে, সেভাবে চলার জন্য পরামর্শ দেওয়া। এতে মা ও শিশুর শরীর-স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। সন্তান ডেলিভারিতে মানুষের অর্থ কম খরচ হবে। সর্বোপরি দেশ পাবে সুস্থ-সবল জাতি।

লেখক : কনটেন্ট ক্রিয়েটর, আরটিভি

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন
Advertisement
Advertisement


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |