বেশিরভাগ অভিধানে সাক্ষরতা বলতে সাধারণত পড়তে এবং অন্তত একটি ভাষায় লিখতে পারার সক্ষমতাকে বোঝানো হয়৷ কাজেই সাক্ষরতা অর্থ হলো পড়তে ও লিখতে পারার সক্ষমতা। আজ আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যদিয়ে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। এবছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘সাক্ষরতা শিখন ক্ষেত্রের প্রসার’।
গবেষকদের মতে, ১৯৫০ সালের আগে সাক্ষরতা এবং পরবর্তী সময়ের সাক্ষরতার সংজ্ঞায় পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৫০ সালের আগে সাক্ষরতা বলতে সাধারণত অক্ষর চেনার সক্ষমতা বোঝানো হতো৷ ১৯৫০ এর পরবর্তী সময়ে সাক্ষরতা বিষয়টি প্রসারিত হতে থাকে। কার্যকরী সাক্ষরতা (ফাংশনাল লিটারেসি) শব্দটি জন্মলাভ করে৷ সাক্ষরতার ঐতিহাসিক ধারণা প্রসারণের পর সাক্ষরতা বলতে বোঝানো হয়- রচনামূলক লেখাপড়া, শিক্ষা ও গবেষণা, নৃতাত্ত্বিক ভাষাগত দক্ষতা ইত্যাদি। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ের বাইরেও লিখতে ও পড়তে পারার ক্ষমতা। উল্লেখ্য, লেখা ও পড়া সংস্কৃতিগত দিক থেকে কখনো আলাদা বিষয় ছিলো না। অক্ষরগত দক্ষতা অর্জনের উদ্দেশ্যে একদম গোড়ার দিকে শুধু বিদ্যালয়ের প্রচলন ছিলো।
আবার আভিধানিক অর্থে সাক্ষরতা হলো অক্ষর পরিচিতি, লেখা ও পড়ার ক্ষমতা। অর্থাৎ যদি কোনো ব্যক্তি কোনো বিষয় পড়ে, সেটা লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করতে সক্ষম হয় তাহলে তাকে সাক্ষর বলে। UNESCO-র বিশেষজ্ঞ কমিটি সাক্ষরতার সংজ্ঞা দিয়েছে, ‘A literate person is one who can, with understanding, both read and write a short simple statement on his or her everyday life.’ একজন ব্যক্তির পাঠের ক্ষমতা অক্ষর পরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে পাঠের বিষয়ের বোধগম্যতা ও লিখে নিজের মনের ভাব-প্রকাশের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
সাক্ষরতা শব্দটি দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়- ব্যবহারিক সাক্ষরতা এবং আনুষ্ঠানিক সাক্ষরতা। ব্যবহারিক সাক্ষরতা বলতে বোঝায় লেখা, পড়া এবং গণিতের সাধারণ জ্ঞান অর্জন করা। আর আনুষ্ঠানিক সাক্ষরতা হলো- প্রচলিত স্কুল, কলেজে পড়ে যে শিক্ষা পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে বলা যায়, সাক্ষরতা হারকে শুধু নিজের নাম স্বাক্ষর করার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার সময় শেষ হয়েছে। সাক্ষরতার সঙ্গে সক্ষমতার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।
সাক্ষরতা দিবস কি?
আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হলো জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা বা ইউনেস্কো-ঘোষিত একটি আন্তর্জাতিক দিবস। ১৯৬৬ সালের ২৬ অক্টোবর ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনের ১৪তম অধিবেশনে ৮ সেপ্টেম্বর তারিখকে ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৭ সালে প্রথমবারের মতো দিবসটি উদযাপিত হয়। দিবসটির লক্ষ্য ব্যক্তি, সম্প্রদায় এবং সমাজের কাছে সাক্ষরতার গুরুত্ব তুলে ধরা। বর্তমানে জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্র এ দিবসটি উদযাপন করে থাকে।
২০২২ এর সাক্ষরতা দিবস
প্রতি বছর, ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের জন্য একটি থিম নির্বাচন করে। এবার সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা গড়ে তোলার জন্য সাক্ষরতা শেখার স্থানগুলির গুরুত্ব সম্পর্কে লোকদের অবহিত করতে ২০২২ সালে দিবসটির থিম- ‘Transforming Literacy Learning Spaces’।
একটি বই পাঠকদের অনেক জগতে নিয়ে যেতে পারে। হতে পারে সেটা বাস্তব বা বানোয়াট। সাক্ষরতা দক্ষতা জীবনের অনেক ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করতে পারে। এছাড়াও, মৌখিকভাবে এবং লেখার মাধ্যমে যোগাযোগ করার ক্ষমতা আমাদের অন্যদের সাথে সংযোগ তৈরি করতে এবং বিশ্ব দরবারে সুযোগের দুয়ার খুলতে সাহায্য করতে পারে।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষের জীবনকে বদলে দিতে পারে সাক্ষরতা। এই কারণেই ইউনেস্কো জনসাধারণকে সাক্ষরতার গুরুত্বের কথা মনে করিয়ে দিতে প্রতি বছর ৮ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
প্রতি বছরের মতো এবারও যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি উদযাপন করা হবে জানিয়ে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। মন্ত্রণালয় জানায়, কেন্দ্রীয় পর্যায়ে পোস্টার ছাপানো ও বিতরণ এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
ধারণা করা হচ্ছে মহামারির পরে, প্রায় ২৪ মিলিয়ন শিক্ষার্থী কখনও আর আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় ফিরে আসতে পারবে না। যার মধ্যে ১১ মিলিয়ন মেয়ে এবং তরুণী বলে অনুমান। কেউ যেন পিছিয়ে না থাকে তা নিশ্চিত করার জন্য, আমাদের একটি সমন্বিত পদ্ধতির মাধ্যমে বিদ্যমান শেখার স্থানগুলিকে সমৃদ্ধ ও রূপান্তরিত করতে হবে। আজীবন শিক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে সাক্ষরতা শিক্ষাকে সক্ষমতার পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে।
এবারের থিম বিবেচনায় ধারণা করা যায়- সবার জন্য মানসম্মত, ন্যায়সঙ্গত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা নিশ্চিত করতে সাক্ষরতা শেখার স্থানগুলির মৌলিক গুরুত্ব পুনর্বিবেচনার একটি সুযোগ তৈরি হবে।
বৈশ্বিক পর্যায়ে, আইভরি কোস্টে ৮ ও ৯ সেপ্টেম্বর দুই দিনের আন্তর্জাতিক ইভেন্টের আয়োজন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস বিশ্বব্যাপী উদযাপনের কারণে আঞ্চলিক, দেশ এবং স্থানীয় পর্যায়ে নিজ নিজ গুরুত্ব বহন করে।
দিবসটি উদযাপনের যৌক্তিকতা
পৃথিবীর প্রায় ৭৭৫ মিলিয়ন অধিবাসীর ন্যূনতম প্রয়োজনীয় অক্ষরজ্ঞানের অভাব রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক প্রতি পাঁচ জনে একজন এখনও শিক্ষিত নন এবং এই জনগোষ্ঠীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই নারী। বিশ্বের প্রায় ৬০.৭ মিলিয়ন শিশু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত এবং আরও অনেকে শিক্ষায় অনিয়মিত বা শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে।
ইউনেস্কোর ‘সবার জন্য শিক্ষার বৈশ্বিক নিরীক্ষণ রিপোর্ট (২০০৬)’ অনুসারে, অঞ্চলভিত্তিতে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সাক্ষরতার হার সবচেয়ে কম (৫৮.৬%); এরপরেই রয়েছে সাব-সাহারান আফ্রিকা অঞ্চলের অবস্থান (৫৯.৭%)। বিশ্বের সবচেয়ে কম সাক্ষরতার হারের দেশগুলো হলো বুর্কিনা ফাসো (১২.৮%), নাইজার (১৪.৪%) ও মালি (১৯%)। প্রতিবেদনে দেশগুলোর নিরক্ষরতার হারের সাথে চরম দারিদ্র্য এবং নারীদের সামাজিক অবস্থানের সাথে নিরক্ষতার সুস্পষ্ট সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়।
শিক্ষিত আর সাক্ষরতার হার কি এক?
বিষয় দুটির হার অবশ্যই এক নয়। কারণ সাক্ষর ব্যক্তি শিক্ষিত নাও হতে পারেন। এটা প্রতিটি মানুষের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে। অন্যভাবেও বলা যায়। সাক্ষরতা হলো যে সাক্ষর করতে পারে, আর শিক্ষিত হলো যে শিক্ষাগ্রহণ করেছে। এজন্য একটি দেশের সাক্ষরতা এবং শিক্ষিতের হার আলাদা হওয়াটাই স্বাভাবিক। সাক্ষরতা এবং শিক্ষিত দুইটি ভিন্ন বিষয়। আসলে যে সম্পূর্ণভাবে শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে তাকে আমরা শিক্ষিত হিসেবে অভিহিত করতে পারি।
এই নিবন্ধের আলোচনায় নিশ্চয়ই এটা বোঝা গেছে যে, সাক্ষরতা শুধু অক্ষর জ্ঞান আর নিজের নাম স্বাক্ষর করার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রেখে আদতে কাজের কাজ কিছুই হবে না। এর পাশাপাশি রিডিং পড়া এবং সেই অনুযায়ী লিখতে পারার সক্ষমতাটুকুও সাক্ষরতা জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির থাকা চাই। এবারের থিম অনুযায়ী শেখা ও শিক্ষণের জায়গাগুলোকেও গুরুত্ব দিতে হবে। এবারের সাক্ষরতা দিবসের এটাই হোক আমাদের ব্রত।