ঢাকা

খেজুরের রস আহরণে ব্যস্ত গাছিরা

আরটিভি নিউজ

শুক্রবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২২ , ০৯:৪০ এএম


loading/img

প্রকৃতির পালাবদলে এখন প্রভাতে শিশির ভেজা ঘাস আর সামান্য কুয়াশার আবরণ জানান দিচ্ছে শীত চলে এসেছে। শীত আসলেই প্রকৃতি যেন এক নতুন রূপে সাজে। সকালে কুয়াশায় চাদরে মোড়ানো থাকে চারদিক। তারপর দেখা মেলে মিষ্টি রোদের। রোদ শেষে আবার কুয়াশার দেখা মেলে। এ যেন অদ্ভুত এক সৌন্দর্য্যের মিলনমেলা দেখা যায় শীতকালে। 

বিজ্ঞাপন

আর শীতের সকালে প্রকৃতির পালাবদলে আরেক অপরূপ সুন্দরের দেখা মেলে। আর তা হলো খেজুর গাছ থেকে রস আহরণ। ভোরে খেজুর রস আহরণের বিষয়টি বেশ বিস্ময়ের। খেজুর গাছকে বলা হয় ‘মধুবৃক্ষ’। এ গাছ থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে রস আহরণ করা হয়।

প্রতি বছর হেমন্তেই শুরু হয় গাছিদের মহাব্যস্ততা। শীতকালজুড়েই তাদের এই ব্যস্ততা লক্ষ্য করা যায়। গ্রামীণ জনপদে খেজুর গাছ ও গাছিদের নিবিড় সম্পর্ক চোখে পড়ে। অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে ঐতিহ্যের খেজুর গাছ কেটে গাছিরা রস আহরণ করেন। এ রসের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। বিশেষ করে শীতকালে গ্রামাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি ঘরেই খেজুর রস দিয়ে চলে পিঠা-পুলি তৈরির হরেক আয়োজন।

বিজ্ঞাপন

সারা বছর ফেলে রাখা খেজুর গাছের যত্ন বেড়ে যায় শীতকাল আসলেই। কারণ, খেজুর গাছ থেকে আহরণ করা হয় সুমিষ্ট ও মূল্যবান রস। যা দিয়ে গুড়-পাটালি তৈরি করা হয়। 
 
এদিক থেকে যশোরের খেজুরের রস-গুড়ের বেশ যশ ও খ্যাতি রয়েছে। ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস, এমনই এক প্রবাদ প্রচলিত সারাদেশে।

যশোরের খেজুর গুড়ের চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে। যশোরের ঐতিহ্য ছিল খেজুরের রস গুড়। কিন্তু এখন খেজুর গাছ কমে যাওয়ায় পর্যাপ্ত পরিমাণ রস সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না গাছিদের। বর্তমানে গুড় তৈরি করতে অধিক খরচ হওয়ায় লাভের ভাগ খুব বেশি হয় না। এজন্য অনেক গাছি এ কাজ ছেড়ে দিয়েছে। আবার অনেকেই কাজের ফাঁকে এ কাজ করে থাকে। একসময় খেজুর গাছ থেকে গুড় উৎপাদন একটা বাড়তি আয়ের উৎস ছিল কৃষকের। তাই গাছিরা অন্যান্য কাজের সঙ্গে তাদের খেজুর গুড় তৈরির কাজ ধরে রেখেছে।

শীত শুরুর সঙ্গে সঙ্গে গাছিরা খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। খেজুর গাছ কেটে পরিষ্কার করে শুরু করে রস সংগ্রহ। মাটির কলসিতে সারারাত রস জমে। ভোরের আলো বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাছিরা রস ভর্তি মাটির ভাঁড় নামিয়ে এনে এক জায়গায় জড়ো করে। পরে এই রস টিনের ট্রে (তাবাল) পাত্রে জ্বাল দিয়ে ঘন করে গুড় মাটির ভাঁড় (হাঁড়ি) বা বিভিন্ন আকৃতির পাত্রে রাখা হয়। গুড় জমাট বেঁধে পাত্রের আকৃতি ধারণ করে। কখনও কখনও এর সঙ্গে নারিকেল কিম্বা তিল মিশিয়ে ভিন্ন স্বাদ দেওয়া হয়। 

বিজ্ঞাপন

যশোরের বেশির ভাগ গ্রামে এখনও চোখে পড়ে খেজুর গাছের বিশাল সমারোহ। জমির আইলে ও পতিত জায়গায় অসংখ্য খেজুর গাছ লাগিয়েছেন এলাকার কৃষকরা। খেজুরের রস আহরণের মধ্য দিয়েই এ গ্রামীণ জনপদে বাড়তে থাকে শীতের আমেজ। শীত যত বাড়বে, খেজুর রসের মিষ্টিও তত বাড়বে। শীতের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ দিনের শুরুতে খেজুরের রস, সন্ধ্যা রস ও সুস্বাদু গুড়-পাটালি। শীতে বাড়িতে বাড়িতে খেজুরের রস জ্বালিয়ে পিঠা-পায়েসসহ নাম না জানা হরেক রকমের মুখরোচক খাবার তৈরির ধুম পড়ে। সুস্বাদু পিঠা ও পায়েস তৈরিতে আবহমান কাল ধরেই গ্রামবাংলার প্রধান উপকরণ খেজুরের গুড়। খেজুরের রস বিক্রি ও গুড় তৈরির কাজও এ এলাকার অনেক কৃষকের প্রধান শীতকালীন পেশা।

বিজ্ঞাপন

যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার খাজুরা নামক স্থানে খেজুর গাছের আধিক্য থাকার কারনে এলাকাটির নামকরণ করা হয়েছে খাজুরা।

এ বিষয়ে সদর উপজেলার মথুরাপুর গ্রামের কৃষক আজিজুর রহমান বলেন, এখানকার খেজুরের গুড় ও পাটালির চাহিদা দেশ-বিদেশে সর্বত্র রয়েছে। দুই দশক আগেও প্রচুর খেজুরের গাছ ছিল। বর্তমানে আগের তুলনায় গাছ অনেকটা কমে গেছে। সরকারি উদ্যোগে নতুন করে খেজুরের চারাগাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়ায় গাছিদের মধ্যে চাঞ্চল্যতা ফিরে এসেছে। এক ভাঁড় খেজুর রস এক শ’ থেকে দেড় শ’ টাকায় এবং এক কেজি বিশুদ্ধ খেজুর গুড় ৩৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে।

সদর উপজেলার নরেন্দ্রপুর গ্রামের গাছি সেলিম মিয়া বলেন, প্রথমে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে গাছের আগা কাটা হয়। মৌসুমের শুরুতে ব্যাপক তোড়জোড় শুরু হওয়ায় একা সম্ভব হয় না। গাছের আগা কাটার জন্য অবশ্য শ্রমিকদের ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা মজুরি দিয়ে গাছ কাটাতে হয়।

তিনি বলেন, রস সংগ্রহের সময় অর্থাৎ শীত মৌসুমের পুরো চার মাসজুড়ে বাড়িতে খেজুরের গুড় ও পাটালি তৈরি করা হয়। ওই সময় আমাদের প্রতিদিন আয় হয় এক থেকে দুই হাজার টাকা। অনেকের আবার খেজুর গাছ কেটেও সংসার চলে। এ মৌসুমে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা রূপদিয়া, বসুন্দিয়া, ছাতিয়ানতলা ও খাজুরা, মণিরামপুর ও রাজগঞ্জ বাজারে গুড়ের হাটে হাজির হয়। জেলার সবচেয়ে বড় খেজুর গুড়ের হাট বসে রূপদিয়া, মণিরামপুর ও রাজগঞ্জে। অন্যান্য জেলায় এমনকি দেশের বাইরেও অনেক ব্যবসায়ী সরাসরি গাছিদের কাছে অর্ডার দিয়ে পাইকারি মূল্যে কিনে সরবরাহ করে থাকেন যশোরের সুস্বাদু এই গুড়-পাটালি।

রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরির বিষয় জানতে চাইলে সদর উপজেলার আন্দুলিয়া গ্রামের গৃহবধূরা বলেন, শীতের সকালে খেজুর রস যে কতটা তৃপ্তিকর, তা বলে বোঝানো যাবে না। সকাল হলেই খেজুর রস, পিঠা ও গুড়ের মৌ মৌ গন্ধে ভরে ওঠে গ্রাম। শীতের খেজুর রসের পিঠা-পায়েশ খুবই মজাদার। শীতের সকালে খেজুর রস দিয়ে ক্ষীর, পায়েশসহ হরেক রকমের পিঠা তৈরির ধুম পড়ে। শীতের সকালে গ্রামের বাড়ির উঠানে মিষ্টি রোদে বসে খেজুরের গরম গরম গুড় দিয়ে রুটি খাওয়ার মজাই আলাদা। খেজুর গুড়ের পাটালি দিয়ে নতুন ধানের মুড়ি খুবই মুখরোচক। খেজুরের নলেন গুড় ছাড়া শীতকালীন পিঠা উৎসবের কথা ভাবাই যায় না।

যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ জেলায় মোট খেজুর গাছের সংখ্যা ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৫৫টি। এরমধ্যে রস উৎপাদিত হয় ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৫টি খেজুর গাছ থেকে। এসব খেজুর গাছ থেকে বছরে ৫ কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার ২৫০ লিটার রস উৎপাদিত হয়। বছরে গুড় উৎপাদিত হয় ৫২ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৫ কেজি। যার বাজার মূল্য এক শ’ কোটি টাকার ওপরে। বর্তমানে জেলার ৮ উপজেলায় গাছির সংখ্যা প্রায় ১৩ হাজার ২০০ জন।

যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মঞ্জুরুল হক জানান, বিশুদ্ধ খেজুর রস-গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যে জেলার গাছিদের সঙ্গে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা নিয়মিত যোগাযোগ রেখে যাচ্ছেন এবং তাদেরকে পরামর্শ দিচ্ছেন। গাছিদের আধুনিক পদ্ধতিতে রস সংগ্রহ থেকে শুরু করে বিশুদ্ধ গুড় উৎপাদন পর্যন্ত যা যা করার প্রয়োজন যেসব বিষয়ে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে। এ জেলার খেজুর গুড়ের চাহিদা দেশে ও বিদেশে বেশি থাকায় এখানে বিশুদ্ধ গুড়ের বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।

আরটিভি খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিজ্ঞাপন
Advertisement
Advertisement

Loading...


© স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত ২০১৬-২০২৫ | RTV Online |