• ঢাকা মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১
logo

উন্নয়নের আড়ালে হাসিনা সরকারের যত আর্থিক কেলেঙ্কারি

কানিজ ফাতেমা শিমু

  ২১ আগস্ট ২০২৪, ২৩:৪৬

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। শেখ হাসিনা সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে বিপুল পরিমাণ অর্থলুট, পাচার, এবং অনিয়মের ফলে দেশের অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ সংকট। ২০০৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৪টি বড় অনিয়মের কারণে ব্যাংক থেকে লুট হয়েছে প্রায় ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। এসবের মধ্যে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের নামে নেওয়া ঋণের বেশির ভাগই লুট হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, আওয়ামী লীগ গত দেড় দশকে কিছু রাস্তাঘাট, ব্রিজ, মেট্রেরেলের মতো অবকাঠামো তৈরি করেছে। কিন্তু বিপরীতে ধ্বংস করে দিয়েছে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান। দেশের বিচার বিভাগ, প্রশাসন, পুলিশ, বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), নির্বাচন কমিশনসহ বেঁচে নেই কোনো প্রতিষ্ঠানই। সর্বোপরি এসবের ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে। যা স্পষ্ট হয়ে উঠছে প্রতিটি নাগরিকের জীবনযাত্রায়ও।

২০০৯ সালে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। তবে আজ সেই ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকায়। এর মধ্যে দেড় দশকে দেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থপাচারের ফলে দেশের অর্থনীতির ভিত নড়বড়ে হয়ে পড়েছে, যা আরও সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বাংলাদেশকে।

২০১১ সালে শেয়ারবাজারে ঘটে যাওয়া ধস ছিল দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য একটি বড় ধাক্কা। ২০০৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে শেয়ারবাজারে অস্বাভাবিক উত্থান দেখা যায়, কিন্তু ২০১১ সালের জানুয়ারিতে আকস্মিকভাবে ঘটে ১০ শতাংশ পতন। এর পরের মাসে আরও বড় পতন ঘটে, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। সেই সময়ে বাজারের অস্থিতিশীলতা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হন। তদন্তে ৬০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে দায়ী করা হলেও, তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে অন্যতম বড় কেলেঙ্কারি হল হলমার্ক-সোনালী ব্যাংক ঋণ জালিয়াতি। ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে, সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে ৩৫ বিলিয়ন টাকা ঋণ নেওয়া হয়। এরমধ্যে ২৭ বিলিয়ন টাকা চলে যায় হলমার্ক গ্রুপের কাছে, আর বাকি টাকা পাঁচটি কোম্পানির মধ্যে ভাগ হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি ছিল সবচেয়ে বড় ব্যাংক জালিয়াতি, যা দেশবাসীকে হতবাক করে দেয়।

একইভাবে বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি ছিল আরও একটি বিশাল দুর্নীতি। ২০১০-২০১২ সালের মধ্যে, ব্যাংকটির শীর্ষ কর্মকর্তারা যাচাই ছাড়াই প্রায় ৪০০০ কোটি টাকার ঋণ ইস্যু করেন। এর ফলে দেশের ব্যাংকিং খাতের ওপর পড়েছে চরম প্রভাব, যা এখনও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। পদ্মা সেতুর দুর্নীতি কেলেঙ্কারি বিশ্বব্যাংকের ১.২ বিলিয়ন ঋণ বাতিলের কারণ হয়। দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক ঋণ বাতিল করলেও, বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে সেতুটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও প্রকল্পটি সফলভাবে শেষ হয়, তবে দুর্নীতির এই অভিযোগ দেশের সুনামকে ক্ষুণ্ন করে।

২০১৬ সালে ঘটে আরেকটি ভয়াবহ ঘটনা-বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি। হ্যাকাররা একটি সাধারণ ইমেইলের মাধ্যমে বাংলাদেশের রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করে। এই অর্থ নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রক্ষিত ছিল, যা ফিলিপাইনের বিভিন্ন ব্যাংক এবং ক্যাসিনোতে স্থানান্তরিত হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে সোনার মান পরিবর্তনের ঘটনাও একটি বড় কেলেঙ্কারি হিসেবে সামনে আসে। ২২ ক্যারেটের সোনা ভল্টে জমা রাখার পর হয়ে যায় ১৮ ক্যারেট। এই অনিয়মের ফলে সরকারের ক্ষতি হয় প্রায় ২ কোটি টাকা।

শেখ হাসিনা সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির ফলে দেশের অর্থনীতিতে নেমে আসে ভয়াবহ বিপর্যয়। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, লুট হওয়া এই অর্থ দেশের জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ এবং (২০২৩-২৪) বাজেটের ১২ শতাংশেরও বেশি। অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করছেন, এই ধরনের অনিয়ম বন্ধ করা না গেলে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।

সম্প্রতি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও সংকটময় হয়ে উঠেছে যখন সরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার পর তা ফেরত আসছে না। এদিকে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও বাংলাদেশকে সতর্ক করেছে যে, যদি এই অর্থনৈতিক অবস্থা অব্যাহত থাকে, তাহলে বাংলাদেশকে একটি ‘ঋণ ফাঁদে’ পড়তে হতে পারে।

১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার সরকারি ঋণ রেখেই ছাত্রজনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার পরিবার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার এই দুর্নীতির তদন্তে গুরুত্ব দিচ্ছে এবং দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে। তবে এই বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন কতটা সম্ভব, সেটাই এখন সময়ের প্রশ্ন।

মন্তব্য করুন

Radhuni
  • বিশেষ প্রতিবেদন এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
বৃষ্টি ও বন্যা নিয়ে সবশেষ যা জানা গেল
নারী ক্রিকেটের ‍উন্নয়নে নতুন টুর্নামেন্টের সিদ্ধান্ত এসিসির
হাসিনা সরকার উৎখাতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না
শিক্ষার উন্নয়নে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে: রাষ্ট্রপতি