বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানের এই যুগে সবকিছু মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। তেমনি বিজ্ঞানের আর্শিবাদপুষ্ট এই যুগে এখন ঘরে বসে চাঁদে ভ্রমন করা নিছক স্বপ্ন নয়,বাস্তবও বটে। ত্রি-মাত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে ঘরে বসেই চাঁদে ভ্রমন করা যায়। আর এ পদ্ধতিটি হলো ভার্চুয়াল রিয়েলিটি । ডিজিটাল বিশ্বে আমরা অনেকেই ভার্চুয়াল রিয়েলিটি শব্দটির সাথে পরিচিত। প্রকৃত অর্থে বাস্তব নয় কিন্তু বাস্তব চেতনার উদ্রেককারী বিজ্ঞাননির্ভর কল্পনাকে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বলে।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি মূলত কম্পিউটার প্রযুক্তি ও সিমুলেশন তত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ শব্দটি প্রথম ব্যবহার হয় ফরাসি নাট্যকার কবি অ্যান্টোনিন আরচিউড এর ‘দ্যা থিয়েটার এন্ড ইটস ডাবল’ বইটিতে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে ত্রি-মাত্রিক ইমেজ তৈরির মাধ্যমে অসম্ভব কাজও সম্ভবপর হয়। ইচ্ছে করলেই যে কেউ এখন অজপাড়াগাঁ এর ছোট্ট শিশুটির স্বপ্নের দেশ ‘চাঁদের দেশ’ অর্থাৎ চাঁদের মাটিতে হেটে আসতে পারে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতম অঞ্চলে ঘুরে আসা কিংবা জুরাসিক পার্কের সেই আতিকায় ডায়নোসরের তাড়াও খাওয়া যায়। অর্থাৎ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হলো কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ যেখানে ব্যবহারকারী ঐ পরিবেশে মগ্ন হতে পারে,বাস্তবের ন্যায় দৃশ্য উপভোগ করতে এবং বাস্তবের ন্যায় অনুভূতি প্রভৃতি অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে।
ভার্চুয়াল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ব্যবহারকারীকে মাথায় হেড মাউন্টেড ডিসপ্লে (Head Mounted Display), হাতে একটি ডেটা গ্লোভ (Data Glove) বা একটি পূর্ণাঙ্গ বডি স্যুইট (Body Suit) ও চোখে চশমা পরতে হয়। হেডসেটটি চোখ ও কানকে ঢেকে রাখে এবং এটি দ্বারা দৃশ্য দেখা ও শোনা যায়। হাতের সাথে যুক্ত ডেটা গ্লোভস নির্দিষ্ট কাজের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনার কাজ করে । যার ফলে এ প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে বাস্তব দৃষ্টিগ্রাহ্য জগৎ তৈরি করা হয় যা উচ্চমাত্রায় তথ্য বিনিময় মাধ্যমের কাজ করে।
সম্প্রতি গুগলও খরাবষু নামে ভার্চুয়াল চ্যাটিং সার্ভিস চালু করেছে যেখানে একটি ভার্চুয়াল কক্ষে যে কেউ তার বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে প্রবেশ করতে পারে এবং সেখানে ইচ্ছেমতো বস্তু দিয়ে সাজানো ,বন্ধুদের সাথে মারামারি, নাচানাচি ইত্যাদি সম্ভব।
প্রত্যহিক জীবনে কিংবা বর্তমান বিশ্বে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।বলা হয়ে থাকে, পরিবারই যে কোনো শিশুর প্রাথমিক শিক্ষালয়। পরিবারের পাশাপাশি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিশুদের শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করছে।ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে শিশুদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে আকর্ষণীয়ভাবে শিক্ষা প্রদান করা যায়। চিকিৎসাক্ষেত্রেও ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সমানতালে গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে সার্জিক্যাল প্রশিক্ষণে ‘এমআইএসটি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ল্যাপরোস্কোপিক’ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এ পদ্ধতিতে কম্পিউটার সিমুলেশন ব্যবহার করে ল্যাপরোস্কোপিক পরিচালনার বিভিন্ন কৌশল শেখানো হয়। এর ফলে মেডিকেল কলেজের ইন্টার্নি ডাক্তাররা অত্যন্ত সহজ উপায়ে বাস্তব অপারেশন থিয়েটারে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তাছাড়া অপারেশন ও রোগ সম্পর্কিত তাত্ত্বিক বিষয়াদির কার্যপ্রণালি অনুশীলন করতে সক্ষম হয়।
ড্রাইভিং প্রশিক্ষণে আজকাল ভার্চুয়াল রিয়েলিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে সহজেই ড্রাইভিং এর নানা নিয়ম-কানুন আয়ত্ত করা সম্ভব। কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের জন্য চালককে একটি নির্দিষ্ট আসনে বসতে হয়। চালকের মাথায় পরিহিত হেড মাউন্টেড ডিসপ্লে’র সাহায্যে কম্পিউটার দ্বারা সৃষ্ট যানবাহনের অভ্যন্তরীণ অংশ ও আশেপাশের রাস্তার পরিবেশের একটি মডেল প্রদর্শন করা হয়। চালক এক্সেলারেশন,ব্রেকিংয়ের জন্য স্টিয়ারিং হুইল ও প্যাডেল ব্যবহার করে ড্রাইভিং এর বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। বাংলাদেশ পুলিশের মহিলা পুলিশদেরকে ড্রাইভিং শেখানোর জন্য ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করা হয়।মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যতম সংস্থা ‘নাসা’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সংস্থাটি তার কার্যক্রমে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রয়োগ করে থাকে। কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে মহাকাশের পরিবেশ,মহাশূন্যে নভোখেয়াযান বিকল হয়ে গেলে কীভাবে তা সারাতে হবে, কোন যন্ত্র অকেজো হলে তাকে কীভাবে কার্যক্ষম করা যাবে এর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ফলে গবেষণা কীভাবে পরিচালনা করতে হবে তা মহাশূন্যে অভিযানের পূর্বেই শিখে নিতে পারেন নভোচারীগণ এবং মহাকাশে তাদের ভ্রমন অনেক নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়। বর্তমানে শিশু-কিশোরদের জনপ্রিয় অবসর বিনোদন হলো ‘গেমস’ খেলা । শহুরে শিশু-কিশোরদের জন্য কথাটির সত্যতা অনস্বীকার্য।
তাদের অধিকাংশ বিনোদনের সময় জুড়ে থাকে অনলাইনে ‘গেমস’ খেলা। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করে বর্তমানে বিভিন্ন আকর্ষণীয় গেমস তৈরি করা হচ্ছে। ঢনড়ী ৩৬০,চঝ২ এবং কম্পিউটারে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন ধরনের ভার্চুয়াল রিয়েলিটি গেমস রয়েছে। লিনডেন ল্যাবস কর্তৃক সেকেন্ড লাইফ,নিনটেনডো এর ডরর এবং ইলেক্ট্রনিক আর্টস এর ঞযব ঝরসং ইত্যাদি। নগর পকিল্পনায় ত্রি-মাত্রিক ভার্চুয়াল রিয়েলিটি-এর প্রয়োগ ঘটিয়ে নগর উন্নয়নের রুপরেখা, নগর যাতায়ত ব্যবস্থা, নগর আবাসন পরিকল্পনা ইত্যাদি সহজ ও আকর্ষণীয় ভাবে বর্ণনা করা যায়। এতে করে পরিকল্পিত নগরায়নের মাধ্যমে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণেও এখন ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করা হয়। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ,আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার ইত্যাদি কাজে কম সময়ে নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করা যাচ্ছে। তাছাড়া রাতে যুদ্ধ পরিচালনা,শত্রুর অবস্থান ও বিরুপ পরিবেশে শত্রুর সাথে মুখোমুখি যুদ্ধে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। সর্বপরি বিশ্বায়নের এ যুগে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির অবদান অনস্বীকার্য।
অপরদিকে, ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে মানুষ তার কল্পনার রাজ্যে ইচ্ছেমতো বিচরণ করতে পারবে।ফলে দেখা যাবে মানুষ বেশি সময় কাটাবে কল্পনার জগতে এবং বাস্তবতা বা ‘রিয়েল লাইফ’ থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে আসবে।কিন্তু এভাবে যদি মানুষ কল্পনা ও বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য না করতে পারে তাহলে পৃথিবীতে চরম অনিশ্চয়তা বিরাজ করবে। মানুষের পারস্পারিক ক্রিয়া হ্রাস পাবে এবং মনুষ্যত্বহীনতা বেড়ে যাবে। ফলে মানব সভ্যতা বিলুপ্ত হতে বেশি সময় লাগবে না।